জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা
কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা ও দরকষাকষির পর বিএনপিসহ চারটি রাজনৈতিক দলের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি থাকতে গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই জোটের ঘোষণা দেওয়া হলো।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফরখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ, জেএসডির আসম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
এই ফ্রন্টের ঘোষণায় নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ক্ষমতায় গেলে ১১টি লক্ষ্য পূরণেরও ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।
জোট ঘোষণার সময় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা করছি কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নয়, জাতির স্বার্থে। আমরা আশা করি অন্যরাও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সূত্রগুলো জানায়, যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমে এই জোটের সব সিদ্ধান্ত আসবে। তবে যৌথ নেতৃত্বের ধরন কেমন হবে সে ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানা যায়নি।
বিএনপি ও গণফোরামের বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে থাকা অপর দুটি দল হলো, আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য। জেএসডি ও রবের নেতৃত্বাধীন দুটি দলই গত বছর গঠিত যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে রয়েছে। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী যিনি বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি।
তবে জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য ছাড়া যুক্তফ্রন্টের অন্য কোনো দল নবগঠিত চার দলীয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়নি। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে তারা এতে যোগ দিবেন না।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ১১টি লক্ষ্য ও সাত দফা দাবি ঘোষণা করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য:
১. মুক্তিসংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ করা।
২. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।
৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
৫. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।
৬. জনগণের মৌলিক মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।
৭. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা।
৮. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
৯. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
১০. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।
১১. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।
সাত দফা দাবি:
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।
২. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়া।
৩. বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
৪. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা।
৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া।
৬. নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচনপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাঁদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা।
৭. তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া।
Comments