গণতন্ত্রে ‘ক্ষুদ্র মানবের’ ক্ষমতা

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভোটারদের গুরুত্ব সম্পর্কে সাত দশক আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সমস্ত প্রশংসার পেছনে রয়েছেন অতি সাধারণ মানুষ। ছোট একটি পেন্সিল ও কাগজ নিয়ে তারা ছোট একটি বুথে ঢুকে ছোট্ট একটি দাগ এঁকে দেয়। এই ঘটনাটির গুরুত্ব বাগাড়ম্বরপূর্ণ বিশাল বক্তৃতা দিয়েও খাটো করা সম্ভব না।’

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভোটারদের গুরুত্ব সম্পর্কে সাত দশক আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সমস্ত প্রশংসার পেছনে রয়েছেন অতি সাধারণ মানুষ। ছোট একটি পেন্সিল ও কাগজ নিয়ে তারা ছোট একটি বুথে ঢুকে ছোট্ট একটি দাগ এঁকে দেয়। এই ঘটনাটির গুরুত্ব বাগাড়ম্বরপূর্ণ বিশাল বক্তৃতা দিয়েও খাটো করা সম্ভব না।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেনের মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে ছিলেন চার্চিল। যুদ্ধ তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। সময়টা খুব গোলমেলে হওয়ায় স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রয়োজন হয়েছিল। এর জন্য বিল উত্থাপন করে ১৯৪৪ সালের ৩১ অক্টোবর পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তৃতায় লিটল ম্যান থিওরি দেন চার্চিল। বাংলায় যেটাকে বলা যায় ‘ক্ষুদ্র মানব’ তত্ত্ব। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার এই বিল উত্থাপন করতে অনুশোচনায় ভুগতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু যুদ্ধের সময় নির্বাচন আয়োজনের মতো পরিস্থিতি না থাকায় আর কোনো উপায়ও ছিল না চার্চিলের সামনে।

গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চার্চিলের সেই শক্তিশালী বক্তৃতা থেকে এখনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনজ্ঞরা উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও বিভিন্ন সময় নির্বাচনের গুরুত্ব ও ভোটারদের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে চার্চিলের ‘লিটল ম্যান’ বক্তৃতা থেকে ধার করেছেন।

২০০২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘লিটল ম্যান’ বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ‘লিটল ম্যান’ ভোটারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সংযুক্ত যমজদের মতো যাদের আলাদা করা যায় না। মায়ের গর্ভে একই নাড়ী দিয়ে তারা যুক্ত থাকে। বুলেটে নয়, বরং ব্যালটই হলো গণতন্ত্রের হৃৎস্পন্দন। লিটল ম্যানদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। এবং নিজের পছন্দমতো কাউকে বেছে নিতে পারাই হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ভিত্তি।’

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টও ২০১১ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে ‘লিটল ম্যান’ প্রসঙ্গটি এনে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। রায়ে বলা হয়: উইনিস্টন চার্চিলের এই ‘লিটল ম্যান’দেরকে অবশ্যই মুক্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যেতে দিতে হবে। তারা সেখানে গিয়ে ব্যালটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারলে গণতন্ত্র অধরাই থেকে যাবে আর সেক্ষেত্রে সংবিধান শুধুমাত্র দেশের জনগণের মানসিক প্রশান্তির জায়গা হয়ে রয়ে যাবে।

সর্বোচ্চ আদালত আরও উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে যেকোনো অসদুপায়ে কোনো প্রার্থী বা দল যদি নির্বাচনে জয় পেয়ে যায় তাহলে আসলে গণতন্ত্রেরই পরাজয় হয়—যে গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূল ভিত্তি এবং যার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা রক্ত দিয়েছেন এই আশায় যে তারা সব ধরনের শোষণমুক্ত এমন এক সমাজ বিনির্মাণ করবেন যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে।

দুই আদালতের রায় থেকেই একটি বিষয় পরিষ্কার যে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই পরিবেশ তৈরির দায়িত্বটা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে যেন কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্য থেকে ‘লিটল ম্যান’ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন। নির্বাচনের আগে প্রত্যেক দলকেই তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে দিতে হবে। যা থেকে ভোটাররা তাদের প্রতিনিধিদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন।

আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন এক বছর আগে এই ‘লিটল ম্যান’-এর আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি জোর দিয়ে বলেছিল, দেশের জনগণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এরকম বেশ কিছু বিষয় নিয়ে একটি তালিকা করেছিল কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে ছিল সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা।

অথচ গত বছরের ১৬ জুলাই নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার সময় সিইসি বলে দিলেন তফসিল ঘোষণার আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার জন্য তারা কিছুই করতে পারবেন না। ঢাকার উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আসম আব্দুর রবের বাসায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটি বৈঠক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভণ্ডুল করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠার ঠিক তিন দিন পর এই মন্তব্য করেছিলেন সিইসি।

এর পর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির উদ্যোগের আলোচনার জন্য গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে কোনো আলোচনার সুযোগ না দেওয়ায় ওই বৈঠক থেকে তিনি ওয়াক আউট করেন। পরদিন সিইসি বিষয়টি পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন, সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে তারা তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।

আসলেই কি এটা করতে পারবে নির্বাচন কমিশন? ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা পোস্টার বিলবোর্ডসহ ট্রেন-লঞ্চে চড়ে রাজনৈতিক প্রচারণা চালালেন। কিন্তু পুলিশের বাধায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এরকম কিছুই করতে পারল না। গত কয়েক বছর ধরেই বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রেখেছে পুলিশ। তাছাড়া যে কোনো রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করতে তাদের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সমাবেশের অনুমতি দিতে প্রথমে অস্বীকার করেছিল পুলিশ। এই অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচন কমিশন কিভাবে তফসিল ঘোষণার পর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে?

বাস্তবতা হলো, মুক্ত পরিবেশেই কেবলমাত্র ভোটাররা তাদের ব্যালটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। চার্চিল নিজেও এই লিটল ম্যান-এর ক্ষমতার আঁচ পেয়েছিলেন। ২০১১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলই ছিলেন সম্ভবত ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। এই সময়ের মধ্যে জনমত জরিপে চার্চিলের প্রতি সমর্থন কখনই ৭৮ শতাংশের নিচে নামেনি। ১৯৪৫ সালে তার প্রতি সমর্থন বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩ শতাংশে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা ভবিষ্যৎবাণী করে বলেছিলেন যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে তিনি কনজারভেটিভ পার্টিকে বিজয়ী করবেন।

কিন্তু যখন ভোটের দিন এলো তখন সব ভবিষ্যৎবাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করলেন সেই ‘লিটল ম্যান’ । ফলাফলে দেখা গেল চার্চিলের কনজারভেটিভ পার্টি লেবার পার্টির কাছে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দিয়ে নাৎসিদের পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন, শান্তির সময়ে এসে তিনি নিজেই পরাজিত হলেন। গণতন্ত্রে ‘ক্ষুদ্র মানবের’ ক্ষমতা এমনই।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: আবু সাদিক

Click here to read the English version of this opinion piece

Comments

The Daily Star  | English

Pollution claims 2.72 lakh lives in one year

Alarming levels of air pollution, unsafe water, poor sanitation, and exposure to lead caused over 2.72 lakh premature deaths in Bangladesh in 2019.

6h ago