পুলিশ-সালিস: গুরুচরণ দশায় ঢাবির গুরু-শিষ্য

শিক্ষামানের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে যতো তলানিতেই ডুবুক, মাঝে মাঝে কদাকার যতো ঘটনাই ঘটুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই— এমনটা ভেবে অভ্যস্ত দেশের লাখো মানুষ। এর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি ইতিহাসের খেরোখাতায় চলে যাওয়ার লক্ষণ সবার জন্যই বেদনার। এ বিদ্যাপীঠটি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যার বিশাল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী স্বাধীনতা আন্দোলনে গণহত্যার শিকার হয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। এর পূর্বাপরে প্রতিটি গণআন্দোলনে মাত্রা যোগ তারাই করেছেন। তাই অনেকেই একটা জায়গায় একমত,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে বাংলাদেশ হতো না।

হালে লক্ষণ বড় বেগতিক, গুরুচরণ। এক একটি দুঃখজনক ক্রিয়াকর্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের কেবল সর্বনাশ নয়, কলঙ্কিতও করে ছাড়ছে। এই ধারাপাতে সর্বশেষ যোগ হয়েছে ছাত্র না হয়েও টানা ৩ বছর ক্লাস করে ষষ্ঠ সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে গিয়ে ধরা পড়া অছাত্রকে পুলিশে দেওয়ার ঘটনা।

ঢাকাই ছবি নয়, নাটকও নয়; যেন সার্কাস-ম্যাজিক! 'অছাত্র' হয়েও টানা ৩ বছর তিনি ক্লাসে গেছেন। গত ২৪ আগস্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের একটি কোর্সের ইনকোর্স পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষকদের সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তিনি ঢাবির শিক্ষার্থীই নন। ২০১৮-১৯ সেশনের সাজিদ উল কবির ব্যাচের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইনকোর্স পরীক্ষা দিয়েছেন। সহপাঠী ভেবে কতো শিক্ষার্থী তার সঙ্গে বন্ধুত্বও করেছেন, শিক্ষা সফরেও গেছেন। না শিক্ষার্থী, না শিক্ষক— কেউ এতদিন তা টেরও পেলেন না। কিভাবে সম্ভব হলো এই অসাধ্য সাধন?

চিরকুটে ভর্তি, থিসিস চুরি, ভুয়া পিএইচডি, ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা বা 'দছ টাকায় ছা, ছফ, ছমুছা, ছিঙ্গারা'র মতো কাণ্ডকীর্তিতে গত বছর কয়েক গণমাধ্যমে আপডেট নিউজ ট্রিটমেন্ট পেয়ে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর শিক্ষামানের করুণ পরিণতির তথ্য বোনাসের মতো। মানদণ্ডের ঠিকঠিকানা 'ঠিক নয়' দাবি করে র‍্যাঙ্কিং তুড়ি মেরে ফেলে দিয়েছেন উপাচার্য।

এবারের ঘটনা আগের সব ঘটনাকে মার খাইয়ে দিয়েছে। হতভম্ব, স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা আকাশ থেকে পড়া শব্দ-বাক্য দিয়ে এ ঘটনা শনাক্ত করা অসম্ভব। ক্লাস নেওয়া শিক্ষকরা জানলেন না, একসঙ্গে ক্লাস করা শিক্ষার্থীরাও বুঝলেন না ব্যাপারটা। এমন কতো জিজ্ঞাসা বাকি থেকে যাচ্ছে। হঠাৎ ষষ্ঠ সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন তিনি? এর আগের পরীক্ষাগুলো দেননি? দিয়ে থাকলে কীভাবে দিলেন? উত্তীর্ণই বা হলেন কীভাবে? পরীক্ষাগুলোর ফি দেওয়া, ফর্ম ফিলাপ, শিক্ষা সফরে যাওয়াসহ থ্রিলে ভরা যতো কাণ্ডকীর্তি। ব্যতিক্রমের চেয়েও ব্যতিক্রম এ কাণ্ডের হোতা সাজিদকে পুলিশে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অছাত্র, ভুয়া বলে পুলিশে দেওয়াই ‌ঘটনার ফয়সালা?

সাজিদের মাত্র কদিন আগে আরেকজনকে পুলিশে দেওয়ার ঘটনার ইতিহাস তৈরি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে, ঘটনায় কিঞ্চিত রকমফের আছে। ওই হতভাগা মেফতাহুল ভুয়া, অছাত্র বা বহিরাগত  নন। জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। তার ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে সরকার বিরোধী সাব্যস্ত করে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার প্রমাণ দাবি করে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মেফতাহুল মারুফকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন জিয়া  হলের প্রভোস্ট বিল্লাল হোসেন।

শিক্ষার্থীদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে সম্প্রতি ছাত্রলীগের একটি কর্মসূচির ফলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে, এমন অভিযোগ করে মন্তব্য লেখেন তিনি। মারুফ লেখেন, 'সিরিজ বোমা হামলা চালাইছে জামাআতুল মুজাহিদিন নামের একটি জঙ্গি সংগঠন বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে। সেই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত। ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি তারা দায়ী হয়, তাহলে ২০০৮-বর্তমানে গুলশানসহ সব জঙ্গি হামলার জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ।'

মারুফের এই মতকে ক্ষমতার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে জিয়া হলের ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী তাকে ধরে প্রভোস্টের কাছে নিয়ে যান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এটি রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততা। তুলে দেন পুলিশের হাতে। পুলিশ গলদঘর্ম হয়ে যায় এই উটকো ঝামেলায়। হেফাজতে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে তারাও হতভম্ব-স্তম্ভিত। মামলা হিসেবে নেওয়ার মতো 'উপাদান' না পেয়ে পুলিশ তাদের হেফাজত থেকে মারুফকে শিক্ষকদের হেফাজতে ছেড়ে দেয়। মুক্তির পর শাহবাগ থানা থেকে তাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে ছাত্র অধিকার পরিষদের ২ নেতা হামলার শিকার হন।

কাছাকাছি সময়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ফেসবুকে ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে হল ছাড়া করা হয় মুহসীন হলের এক ছাত্রকে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে মধ্যরাতে ছাত্রলীগ কর্মীদের চাপের মুখে হল ছেড়ে চলে যেতে হয় দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী সাকিবকে। এ ঘটনায় হল প্রশাসনের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ করেননি তিনি। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। তাই অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই।

কোনো পাড়া-মহল্লা বা বাস-লঞ্চ টার্মিনাল নয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের মান-মর্যাদা, এর শিক্ষকদের উচ্চতার কী বার্তা মেলে এ ধরনের ঘটনায়? কথায় কথায় গাল হজম করা পুলিশেরই-বা কী উপলব্ধি হলো আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সম্পর্কে?

বিশ্ববিদ্যালয়, তা-ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেবল পড়াশোনার জায়গা নয়। পুলিশে দেওয়া বা বিচারের জায়গাও নয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চার উন্মুক্ত তীর্থ বলে দাবি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু, গত বছর কয়েক ধরে এ গর্বের বাস্তবতা কোন পর্যায়ে? শিক্ষকরা কেবল শিক্ষাগুরু নন, অভিভাবকও। ছাত্র বা ছাত্রনেতা নামধারীদের সমান্তরালে শিক্ষাগুরুরাও যে ভূমিকায় নেমেছেন একে ঘৃণা করতেও ঘৃণার উদ্রেক হয়। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ও ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের মারধর, মানসিক লাঞ্ছনা, গেস্টরুমে হাজিরা দেওয়া, কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা, হল থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা প্রায়ই শিরোনাম হচ্ছে গণমাধ্যমে। কোথাও শিক্ষকরা তা রুখতে বা দমনে এগিয়ে এসেছেন, এমন তথ্য কম। কমের চেয়েও কম। তার ওপর যা তাদের নিজেদের সমাধান করার কথা, সেখানেও পুলিশ ডেকে কোন আচানক বীরত্বের রেকর্ড গড়া শুরু করেছেন?

কোনো শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি বা র‍্যাগিংয়ের শিকার হলে দায়ীকে পুলিশে দেওয়ার রেকর্ড কিন্তু দেখা যায়নি এখনো। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি এক কথায় ভক্তি-স্নেহের মেলবন্ধন। শিক্ষক উদার নির্লোভদাতা, আর শিষ্য প্রশ্নহীন অনুগত গ্রহীতা। বাস্তবতা কী এখন এর ধারে কাছেও?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago