পোশাকের রাজনীতি ও সংস্কৃতি

১৯৭৩ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত

কূপমণ্ডূকতা বাঙালিদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যেমন বাঙালি মুসলমানদের তেমনি বাঙালি হিন্দুদের। ভারতবর্ষে সুদীর্ঘ সময়ের মুসলিম শাসন হটিয়ে ইংরেজরা যখন শাসনভার হাতে নিলো, তখন অফিস-আদালতে তাদের সহযোগী হিসেবে সংগত কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন একাধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। 

কারণ দ্রুতই ফার্সি থেকে শাসক শ্রেণির ভাষা ইংরেজির প্রচলন হয় এবং বাংলার হিন্দুরা ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় এগিয়ে ছিলেন। যদিও ধর্মীয় সংস্কারের কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করতে অনেক সময় লেগেছিল। রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও এবং তার বিপ্লবী শিষ্যরা, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সমাজ পরিবর্তনে তৎপর হলেন, তখন হিন্দু সমাজে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে চিন্তা ও চেতনায় অনেক পরিবর্তন ও নবজাগরণ ঘটেছিল।

উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ ছিল মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব বাংলা এবং এ অঞ্চলের প্রধান শহর ছিল ঢাকা। যথারীতি এ অঞ্চলেও মানুষ ছিল ধর্মান্ধ এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সেই ঢাকায় রেনেসাঁর আলো আসে আরও একশ বছর পর। তাও খুবই সীমিত পরিসরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষক, যেমন- কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ এবং আবুল হুসেন প্রমুখের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ। শিখা গোষ্ঠী নামে যারা পরিচিত ছিলেন। 'শিখা' ছিল তাদের মুখপত্র। সে পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যায় লেখা থাকতো 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'। অগ্রসর চিন্তার এই মানুষরা শত বছরের সংস্কারের অচলায়তনে একটি নতুন যুগের হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। 

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মূলমন্ত্র ছিল 'বুদ্ধির মুক্তি'। তাদের মুখপত্র 'শিখা' ছিল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে গঠিত বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক মনন ও অগ্রযাত্রার অবিস্মরণীয় এক স্মারক। সমাজ সংস্কারে ১৯২৯ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে গ্রহণ করা হয়েছিল ৫ দফা প্রস্তাব। তাদের ৫ দফার অন্যতম একটি দফায় মুসলমান নেতৃবৃন্দকে আহ্বান করা হয়- বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে অবরোধবাসিনী নারীদের পর্দাপ্রথা দূরীকরণ প্রসঙ্গে। উল্লেখ্য, এর মাত্র এক বছর আগে টাঙ্গাইলের এক গ্রাম থেকে ওঠে আসা ফজিলতুন্নেসা পশ্চাৎপদ সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা ও শৃঙ্খল ভেঙে প্রথম বাঙালি মুসলমান নারী হিসেবে স্নাতক পাশ করেন এবং প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে পাড়ি জমান।

সম্প্রতি নরসিংদী রেলস্টেশনে জনৈক তরুণীকে হেনস্তার পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক নিয়ে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির একটি মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী টিএসসিতে মানববন্ধন করেছেন।
  
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, নিয়ত সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া হয় এবং চর্চা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। প্রশ্ন জাগে, বাঙালি মুসলমান সমাজ একশ বছরে কতোটা এগিয়েছে? অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একুশ শতকের এই সময়ে কারও পোশাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক না করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মহাকাশ, জ্ঞান-গবেষণা, দর্শন ও শিল্পকলা নিয়ে ভাবার কথা ছিল। কবি নজরুলের কথাই তাহলে এখনো সমান প্রাসঙ্গিক- 'বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনো বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি ফেকাহ হাদিস চষে।'

যেকোনো দেশ বা অঞ্চলের মানুষের পোশাক নির্ভর করে প্রধানত সে দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু এবং সংস্কৃতির ওপর। অর্থনৈতিক সামর্থ্যেরও যোগসাজশ থাকে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন চর্যাপদে এ অঞ্চলের নারী-পুরুষের পোশাকের তেমন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় ও রমেশচন্দ্র মজুমদার তাদের লেখায় জানিয়েছেন, নারী এবং পুরুষ উভয়ই পরতেন একখণ্ড বস্ত্র–শাড়ি অথবা ধুতি। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উভয়ই ধুতি পরেছেন। পরবর্তীকালে তুলনামূলকভাবে পরতে সুবিধা বলে লুঙ্গির প্রচলন হয়েছে। হিন্দু মুসলিম উভয়েই লুঙ্গি পরেছেন। ভিনদেশি মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, নানা সময় বিদেশি শাসক শ্রেণিও স্থানীয় পোশাক-পরিচ্ছদে প্রভাব ফেলেছে। শেরওয়ানি, আচকান, পাগড়ি পড়ুয়া বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নেহেরু ও জিন্নাহর ফটোগ্রাফ দেখলেই বুঝা যায়, ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনামলের প্রভাব। প্যান্ট, শার্ট, সাহেবি স্টাইলে কোর্ট, শাড়ির পরিবর্তে সালোয়ার কামিজও তার নিদর্শন। এগুলো পোশাকের ও রুচির স্বাভাবিক বিবর্তন। 

একসময় যা ফ্যাশন বা স্টাইল ছিল, তা অন্য সময়ে বিসদৃশ মনে হয়। পোশাক নিয়ে তাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনো অবকাশ নেই। জোর করে চাপিয়ে দেয়ারও কিছু নেই। কে নাক-কান-মাথা ঢাকবে আর কে খোলা রাখবে এগুলো একান্তই ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়। সর্বোপরি একটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো পোশাক পরার ব্যক্তি স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করা জরুরি।

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Gaza rescuers say Israeli forces kill 60, half near aid centres

Civil defence spokesman Mahmud Bassal told AFP that five people were killed while waiting for aid in the southern Gaza Strip and 26 others near a central area known as the Netzarim corridor, an Israeli-controlled strip of land that bisects the Palestinian territory

26m ago