বেগুন সাংবাদিকতা: কৃষক-গবেষকে উদ্বেগ

কারণে-অকারণে এমনিতেই সাংবাদিকদের তেলবাদিক-চাম্বাদিকসহ কতো গালমন্দ হজম করতে হয়। আলু, পটল, ডাঁটা, ঝিঙা, পুঁইশাক বাদ দিয়ে এখন যোগ হয়েছে বেগুনবাদিক। এটা নিয়তি, নাকি একের পাপে বাদবাকি সাংবাদিকদের নিপাতনে সিদ্ধ হওয়া— তা নিস্পত্তিহীন প্রশ্ন।

বেগুন খেলে ক্যানসার হোক বা না হোক, এ মর্মে প্রচারিত তথ্যগুণে সর্বনাশ যা হওয়ার তার অনেকাংশই হয়ে গেছে। বাকি আছে কেবল দেশের তথা সাংবাদিকতার ক্যানসার হওয়া। দেশে বেগুনের গুণ নিয়ে নানা কথা প্রচারিত আবহমান কাল ধরেই। আবার বেগুনের কোনো গুণ নেই বলেও প্রবাদ- প্রচারণা আছে। 'যার নেই কোনো গুণ, তার নাম বেগুন' এমন স্লোকও আছে। কিন্তু, চুলকানি বা এলার্জি ছাড়া বেগুণের গুরুতর আর কোনো দোষের কথা শোনা যায়নি কখনো।

একেবারে টাটকা খবরের মতো বেগুণের গুরুতর দোষের তথ্য প্রচার হয়েছে সম্প্রতি। তাও যেনতেন দোষ নয়, ক্যানসারের ঝুঁকির বদনাম। বাতকে বাত নয়, এ নিয়ে একেবারে গবেষণা রিপোর্ট ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাজারে। একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশো হওয়ার পর কিছু অনলাইনে এর কপি-পেস্ট হয়েছে। পরে যোগ হয়েছে মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যমেও।

গত বছর কয়েক ধরে বাজারে আধিপত্য দেখে বেগুন চাষে ঝুঁকেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক কৃষক। ফলন ও দাম ভালো পেয়ে তাদের লাভবান হওয়ার সাফল্য সংবাদ প্রচার হয় গণমাধ্যমে। বেগুনের এ গুণে দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল অনেক কৃষকের। এখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো হঠাৎ ছেদ পড়লো বেগুনে। সঙ্গে আতঙ্কও।

বেগুনের এই বদগুণের পূর্বাপর তথ্যতালাশে জানা গেছে, আলোচিত ড. জাকির হোসেনের গবেষণাটি প্রকাশ হয়েছে বিশ্বমানের বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল 'নেচার' পাবলিশিং গ্রুপের প্রকাশিত 'সাইন্টিফিক রিপোর্ট' নামক একটি উঁচু মাপের জার্নালে। ১৮৬৯ সাল থেকে এই জার্নালে বিশ্বের খ্যাতিমান গবেষকদের বাছাইকৃত গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। সেখানে এবার যোগ হয়েছে বেগুন।

'নেচার' নাম হলেও এটি পরিবেশ বিষয়ক কোনো ম্যাগাজিন নয়। কিন্তু, ঢাকার গণমাধ্যম গুলিয়ে ফেলেছে বিষয়টি। 'বেগুন খেলে ক্যানসার হয়' অনুবাদে কেবল তালগোলই পাকানো হয়নি, প্যাঁচিয়ে ফেলা হয়েছে ডক্টর, ডাক্তার, গবেষকদেরও। আর বেগুন চাষিদের মাথায় হাত তুলে দেওয়া হয়েছে। মুদ্রণ ও টকশোতে একেবারে সেরের ওপর সোয়া সের।

বেগুন ও গবেষণা বিষয়ে নূন্যতম স্টাডি না করে রীতিমত বেগুন সাংবাদিকতা নামে এক নতুন সাংবাদিকতার জন্ম দিয়ে ফেলেছেন টকশোর সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনসহ কয়েকজন সাংবাদিক। সেইসঙ্গে টক শোতে প্রশ্নের নামে আসামির মতো জেরার তোড়ে একজন খ্যাতিমান কৃষিবিজ্ঞানী তথা গবেষককে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে। সেটা অজ্ঞতা, না বেগুনবিরোধী চক্রান্ত, কোনোটাই পরিস্কার নয়। তবে বেগুনের এই অ্যাপিসোড আচ্ছা রকমের প্রশ্নে ফেললো সাংবাদিকসহ গণমাধ্যম কর্মীদের। বরাবরের নানা ঘটনা বা আলোচনার মতো মানুষ হয়তো কিছুদিনের মধ্যে এটা ভুলে যাবে, সামনে চলে আসবে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কচলানো থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়া কঠিন।

বেগুন যুগ যুগ ধরে বাঙালির সবজির চাহিদা মেটাচ্ছে। বেগুন গণমাধ্যমে অনেকবার শিরোনাম হয়েছে রমজান মাসে। তা প্রথমত বেগুনি ইফতারির গুরুত্বপূর্ণ আইটেম বলে। দ্বিতীয়ত বেগুনির প্রধান উপকরণ বেগুনের চড়া দাম হওয়ায়। কিন্তু, দেশে এ সময়ে এতো এতো সমস্যা থাকতে বেগুনকে বিষয় করার সামান্যতম উপযোগিতা দেখছেন না সাংবাদিকতার পাঠ নেওয়া পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীরা। বড় জোর সবজি কমিউনিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে বেগুনের অতি দাম নিয়ে এক্সট্রা বা সাইড রিপোর্ট হতে পারতো। এমনও নয় যে, করোনা-ডেঙ্গুর চেয়ে দেশে ক্যানসার বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। আবার দেশের গবেষণা রাজ্যে খরা লাগায় বেগুন বিষয়ে একজন সম্মানিত শিক্ষক-গবেষককে নাজেহাল করার মতো উপযোগিতাও দেখা দেয়নি। অথবা দাম চড়ে যাওয়ায় সবজি রাজ্যের ছোট সদস্য বেগুনকে প্রতীকি শাস্তি দিতে হবে। তাহলে কেন বেগুনের পেছনে লাগা? কেন বেগুনালাপ জমানো?

এসব প্রশ্নের সঙ্গে বলতেই হয়, কোনো গবেষককে এভাবে ডেকে কথাপ্রদর্শন (টকশো) বা বুঝবানের জ্ঞান জাহিরে অপমানিত করার মাঝে গৌরব নেই। বরং নিজের অজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে গেছে আপনা-আপনিই। তা গোটা গণমাধ্যম কমিউনিটিকেও খাটো না করে পারে না। আর প্রশ্নের পর প্রশ্নের জন্ম তো দিয়েছেই। এতোদিন কি তাহলে বেগুন সম্পর্কে ভুল জানানো হয়েছে— এ প্রশ্নও ঘুরছে সাধারণ মহলে। চিকিৎসক, পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা কেন এতোদিন জানিয়েছিলেন, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এ সবজিটি শরীরের বিষাক্ত উপাদান কমায়, ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে? বেগুন না ভিটামিন এ, সি, ই এবং কে সমৃদ্ধ? বেগুনের ভিটামিন এ কি আর এখন চোখের পুষ্টি জোগায় না? সবজিটির ভিটামিন সি ত্বক, চুল, নখকে আর মজবুত করবে না? আর সাহায্য করবে না রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে?

অভিমান করে বেগুন যদি আর হার্টকে ভালো রাখার ফাইবারের পাশাপাশি পটাশিয়াম ও ভিটামিন বি-৬ বন্ধ করে দেয়? যা গণমাধ্যমের মতো পূর্ণকালীন শ্রম-ঘাম ঝরানো পেশাজীবীদের জন্য আরও বেশি জরুরি। তবে, বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি ও ব্রনে ভোগাদের বেগুনমুক্ত থাকাই উত্তম। নইলে তথ্য আর অপতথ্য সাপ্লাই চলতেই থাকবে। যাহা উদ্দেশ্য, তাহাই হতে থাকবে বিধেয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Kamal Hossain calls for protecting nation

Kamal Hossain urges vigilance against obstacles to nation-building effort

"The main goal of the freedom — gained through the great Liberation War — was to establish democracy, justice, human rights and build a society free from exploitation. But we have failed to achieve that in the last 54 years," says Dr Kamal

1h ago