বাঁশ-হারিকেন রাজনীতির নয়া সন্ধিক্ষণ

লগি-বৈঠা, হাতুড়ি-হেলমেট নয়, গান পাউডার-বোমাও নয়; রাজনীতির ময়দানে বাঁশ আবার খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তা রূপক অর্থে নয়, একেবারে আক্ষরিক-আভিধানিক তথা প্রায়োগিকভাবেই। বাঁশ মানে বাঁশের লাঠি। রাজধানীসহ দেশের কোথাও কোথাও বিভিন্ন সাইজের বাঁশ কেনাবেচা জমে ওঠার খবরও আসছে।

লগি-বৈঠা, হাতুড়ি-হেলমেট নয়, গান পাউডার-বোমাও নয়; রাজনীতির ময়দানে বাঁশ আবার খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তা রূপক অর্থে নয়, একেবারে আক্ষরিক-আভিধানিক তথা প্রায়োগিকভাবেই। বাঁশ মানে বাঁশের লাঠি। রাজধানীসহ দেশের কোথাও কোথাও বিভিন্ন সাইজের বাঁশ কেনাবেচা জমে ওঠার খবরও আসছে।

পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ বাঁশের নাম 'লাঠিসোটা'। আর আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিরোধী দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল-মিটিং করা অত্যন্ত অ্যালার্মিং, সহিংসতা সৃষ্টির আলামত।  বিএনপি এ বাঁশকে মোটেই অস্ত্র বা লাঠিসোটা মানতে রাজি নয়। তাদের মতে, এ বাঁশ পতাকার বাহন। এরপরও বাধা এলে প্রতিহত করে আত্মরক্ষার একটা মাধ্যম মাত্র। এর পাল্টা অসাধারণ মত দিয়েছেন সরকারি দলের সাধারণ ওবায়দুল কাদের। তার মতে, বাঁশের লাঠির মাথায় পতাকা বেধে মিছিল করা 'পতাকার অবমাননা'। বাঁশধারীদের আগামীতে হারিকেন ধরিয়ে দেওয়ার হুঙ্কারও আছে।

বাঁশ নিয়ে এ লিপ সার্ভিসের মাঝে বিএনপি নেতাদের পাল্টা মত হচ্ছে, তারা তো লগি-বৈঠা বা হাতুড়ি-হেলমেট বহন করছেন না। কথা ও যুক্তির পাণ্ডিত্যে ফয়সালা না এলেও হাল রাজনীতিতে বাঁশ এবার মোটামুটি বৈধতা পেয়ে গেছে। গত কিছুদিনের মিটিং-মিছিল বিশেষ করে বিভাগীয় গণসমাবেশমুখী মিছিল, মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস বহরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাতে বাঁশ সৌন্দর্য (!) শোভা পেয়ে চলছে। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুনের পাশাপাশি ব্যানারের দুদিকে ব্যবহার হচ্ছে বাঁশের হাতল। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকায় ব্যবহার হচ্ছে নানা সাইজের বাঁশের টুকরা। পরিবহণ ধর্মঘট ডেকে বা ডাকিয়ে গণসমাবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার পরও এসব বাঁশের বিরুদ্ধে লগি-বৈঠা বা হাতুড়ি-হেলমেট বাহিনী নামার শঙ্কা থাকলেও এখনও তেমনটি ঘটেনি। এটি কম কথা নয়। কোথাও কোথাও বাঁশের দিকে ইটের জবাব এলেও বন্দুক, চাপাতি, রড, রামদা আসেনি। সেই বিবেচনায় তা অবশ্যই মন্দের ভালো।

বাঙালি মুসলমানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং বেঁচে থাকার পুরোটা সময় জুড়ে বাঁশের অবিরাম ব্যবহার। বাঁশ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি, সাঁকো নির্মাণ এবং কৃষিকাজের উপকরণ জোয়াল, মাথাইল, গরুর মুখের টোনা থেকে শুরু করে টুকরি, ডুলা, ধামা-কুলা-সাজি, ডালার ব্যবহার আবহমান বাংলার জীবন-জীবিকার ঐতিহ্য। বাঙালি ঐতিহ্যের ঘুড়ি তৈরির বিশেষ উপাদানও বাঁশ। নৌকার মাচা, পাটাতনও তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে। কোদাল-কুড়ালের হাতলও হয় বাঁশ দিয়ে। জন্মক্ষণে এক সময় গ্রামাঞ্চলে ভূমিষ্ঠ শিশুর নাড়ি কাটা হতো বাঁশের ফলা দিয়ে বানানো ব্লেড দিয়ে। সুন্নতে খতনাও হতো এ ধরনের বাঁশের চিলতা দিয়ে। আর মৃত্যুর পর দাফনে তো বাঁশ অবধারিত। আবার এ বাঁশ থেকেই বাঁশি বানানো হয়। বাঁশ খাওয়াও হয় কোনো কোনো জায়গায়। হাঁস দিয়ে বাঁশ রান্না পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় অত্যন্ত মুখরোচক আইটেম। রাজধানীতেও ভোজনবিলাসীরা এই রেসিপিটি নিয়ে এসেছেন।

এক কথায় বলা যায়, বাঁশ ছাড়া বাঙালি জীবন কল্পনা করা যায় না। প্রতিটি বাঙালির স্মৃতিপটেই বরাগ, মুলিসহ বহু বাঁশ। ছোটবেলায় কে না গল্প-কবিতায় পড়েছে, 'বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই'। দোল খেয়েছে বাঁশের দোলনায়। গ্রামের মাঠে এখনো ক্রিকেট-হকি খেলা হয় বাঁশের ব্যাটে। গ্রাম-বাংলার মক্তব-স্কুলে এখনো ওস্তাদের হাতে থাকে বাঁশের কঞ্চি। কোনো কোনো স্কুল-মাদ্রাসার পার্টিশনও বাঁশের তৈরি। এমনকি, পতাকা দণ্ডও বাঁশের, যা উত্তোলন করে গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। এক সময় হাতের সুন্দর লেখা তালিম দিতে শিক্ষকরা বাঁশের কলমে লেখাতেন। বাঁশের টঙ ও মাচায় বসে বুট-বাদাম খাওয়ার ঘটনাও অনেক। বাঁশের খাঁচায় পাখি পোষার স্মৃতি এখনো লাগামের মতো টানে। বাঁশের চোঙা ফুঁকিয়ে, বাঁশের চাটাইয়ে বসে গরিবি রাজনীতি চর্চার স্মৃতিও আছে কারো কারো। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের ওঠা-নামার পাটিগণিত করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যে কিছিমের অংক বিশ্বের অন্য কোনো দেশে শেখানোর কথা শোনা যায় না। বাঁশের চোখা ফলা দিয়ে তৈরি টেঁটা-বল্লম কতো ভয়ানক মারণাস্ত্র তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নরসিংদীর অনেকের ভালো জানা।

ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাঁশ কোনোভাবে এখনো পিছু ছাড়ে না। আঠার মতো লেগে আছে বাঙালির যাপিত জীবনের পরতে পরতে। রডের কাজ বাঁশ দিয়ে চালানোর ঘটনা থেকেও ছাড় মেলে না। বাঁশের টান নেওয়ার ক্ষমতা ইস্পাতের চেয়ে বেশি বলে গবেষণায় এসেছে। হাড়-গোড় ভাঙা রোগীর চিকিৎসায় বাঁশ টানা দেওয়ার রহস্য নাকি এখানেই। উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ভালোমতো জানেন, বাঁশ কিন্তু গাছ নয়, ঘাস। তা পানি শুষে নেয়। বাঁশ কংক্রিটের ভেতরে বাড়া-কমা করে কংক্রিটকে ফাটিয়ে দিতে পারে। গাছ তা পারে না। ইঞ্জিনিয়ার-ঠিকাদাররা তা জানেন বলেই, ভবন, সেতুসহ বিভিন্ন স্থাপনায় রড-ইস্পাতের বদলে বাঁশের ব্যবহার উদ্ভাবন। তা একদিকে শৈল্পিক, আরেকদিকে প্রেরণার। কিন্তু, ঘটনাচক্রে ধরা পড়ে গেলে বাধে গোলমাল। দেশে বাঁশশিল্পের আওতা ছোট হয়ে এলেও বাঁশের তৈরি ভাস্কর্য, খেলনা ইত্যাদির কদর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বাঁশের বেড়া রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি সম্ভাবনার খবর সম্প্রতি চমক তৈরি করেছে।

চিন্তা ও উদ্ভাবনে মগ্নদের মধ্যে বাঁশ নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। বাংলাদেশ স্বাধীনের ৬/৭ বছর আগে, ১৯৬৪ সালে ইউএস নেভি ইস্পাতের বদলে বাঁশ দিয়ে কংক্রিট বানানোর পরীক্ষা করেছে। ফলাফলটা প্রকাশ পায়নি। নিহত আবরার-ফারদিনদের শিক্ষালয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বুয়েট) ইস্পাতের বদলে বাঁশ ব্যবহার নিয়ে কিছু গবেষণাকর্ম হয়েছে। সেটা গবেষণা বা লেখালেখি পর্যন্ত হলেও আমাদের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা তা বাস্তবে করে দেখিয়ে দিচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। দুনিয়ার সেরা বাঁশ উৎপাদনকারী, প্রযুক্তিতে বিশ্বসেরা চীনের জন্য তা নিশ্চয়ই আফসোসের। তারা আমাদের মতো বাঁশের ইউটিলিটি ঘটাতে পারেনি। চীনারা মুখ দিয়ে নিয়মিত বাঁশ খায়। আমাদের তা খাওয়ানো হয় অন্যভাবে, অন্যদিক দিয়ে। বাঁশের নির্যাস দিয়েই চীনারা মধ্যযুগে গান পাউডার ধরনের গুঁড়ি তৈরি করেছিল বলে জনশ্রুতি আছে। আজকের যুদ্ধ ময়দানে বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাঁশ থেকে তৈরি সেই গান পাউডার অনেক অঘটন ঘটিয়ে দেয়।

রূপক বা প্রতীকী অর্থে দেশ-সমাজ-সংসার বহু আগ থেকেই বাঁশময়। 'বাঁশ দেওয়া' বাঙালি সমাজে, বিশেষ করে রাজনীতিতে ব্যবহার হয় রূপক অর্থে। এর অর্থ সর্বনাশ করে দেওয়া। হালের 'খেলা হবে, খেলা হবে'র হুমকির মাঝেও সেই বাঁশের বার্তা। পজিশন-অপজিশন কে কাকে বাঁশ দেবে, হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবে- এ সংক্রান্ত কানাঘুষা চলছে রাজনীতির বাজারে। বাঁশের লাঠি হাতে গ্রাম পাহারার ঐক্যের প্রতীক আজ নেই। আবার বাঁশ-হারিকেনের রাজনীতি রুখে দেওয়ার মতো কাউকেও দেখা যাচ্ছে না আশপাশে। প্রযুক্তির কল্যাণে ডিজিটাল ক্রিমিনাল বা সাইবার অপরাধীদের সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে। চাপাতি, রাম দা, হাতুড়ি, হেলমেটের পাশাপাশি পিস্তল, গোলাবারুদের ব্যবহার বাড়লেও অস্ত্র হিসেবে বাঙালির কাছে বাঁশ যতটা টেকসই-লাগসইর প্রতীক, তার কোটি ভাগের এক ভাগও নেই অন্য কোনো শক্তির। শিক্ষার্থীদের জন্যও বাঁশের কঞ্চির মৃদু আঘাত যে সুফল দেয়, অন্যকিছুতে তা দেয় না।  কিন্তু, বাঁশের ইতিবাচক এ প্রতীকী দিকটায় বড্ড খরা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Anontex Loans: Janata in deep trouble as BB digs up scams

Bangladesh Bank has ordered Janata Bank to cancel the Tk 3,359 crore interest waiver facility the lender had allowed to AnonTex Group, after an audit found forgeries and scams involving the loans.

7h ago