রংপুর রঙ্গ, ফরিদপুরে পাঙ্খা

রংপুর-ফরিদপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্নাঞ্চলে ‘পাঙ্খা’ শব্দটি কেবল ‘পাখা’ অর্থে ব্যবহার হয় না। সবল কাউকে দাবিয়ে দুর্বল কারো বেড়ে যাওয়া, প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বোঝাতে বলা হয় পাঙ্খা গজানো। জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগে রংপুর সিটি নির্বাচনে নৌকাকে চরমভাবে ডুবিয়ে দিয়েছে লাঙল। সেইসঙ্গে পাখার দাপট। একই সময়ে ইউপি নির্বাচনে নিদারুণভাবে ‘নৌকাডুবি’ হয়েছে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ঘাঁটিতেও।

রংপুর-ফরিদপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্নাঞ্চলে 'পাঙ্খা' শব্দটি কেবল 'পাখা' অর্থে ব্যবহার হয় না। সবল কাউকে দাবিয়ে দুর্বল কারো বেড়ে যাওয়া, প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বোঝাতে বলা হয় পাঙ্খা গজানো। জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগে রংপুর সিটি নির্বাচনে নৌকাকে চরমভাবে ডুবিয়ে দিয়েছে লাঙল। সেইসঙ্গে পাখার দাপট। একই সময়ে ইউপি নির্বাচনে নিদারুণভাবে 'নৌকাডুবি' হয়েছে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ঘাঁটিতেও।

স্থানীয় নির্বাচন হলেও নানা কারণে ফরিদপুর-রংপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগের গুরুচরণ অবস্থা কিছু বার্তা দেয়। গুরুতর কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অবস্থা কি এতো খারাপ হয়ে গেছে? আওয়ামী লীগ বা নৌকার ঐতিহ্য–দাপটের মুখে কারো এভাবে পাঙ্খা গজানো এতো সোজা? তাহলে কে, কেন, কিভাবে করে দিলো এমন অবস্থা? আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি তো মাঠেই নেই। জামায়াতও দৌড়ের উপর, মাটিতে পা রাখারই জো নেই। নির্বাচনের মাঠ তো আরও পরের ব্যাপার।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মজেলা ফরিদপুর। শ্বশুরবাড়ি রংপুর। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় একটি পৌরসভা ও তিনটি ইউপি নির্বাচনে একটি ছাড়া সবকটিতে ডুবেছে নৌকা। কেবল সদর ইউপিতে শতখানেক ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সোহরাব হোসেন। আলফাডাঙ্গা পৌরসভা, বুরাইচ ও গোপালপুর ইউপিতে গোহারা হেরেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা, নৌকার প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এ তীর্থস্থানটিতে রাজনীতির বাইরের মানুষের কাছেও এটি যারপরনাই আলোচিত ঘটনা।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দলীয় প্রার্থীকে হারিয়েছেন— এ বিবেচনায় তা প্রতিপক্ষের কাছে সুড়সুড়ির মতো খুশির বিষয় হলেও ফরিদপুর অঞ্চলে ব্যাখ্যা হচ্ছে অন্যরকম বিশ্লেষণে। রংপুরেরটি আরও বেশি রঙ্গভরা।

সরকারের বোঝাপড়া বা আজ্ঞাবহ বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে রংপুর সিটির মেয়র পদ মাগনা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি মোটেই এমন নয়। আবার আওয়ামী লীগ সেখানে 'নাই' হয়ে গেছে, এমনও নয়। জামানতই থাকবে না, এমন দশা কি হয়েছে দলটির? আওয়ামী লীগ প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায়। রংপুরে দলটির ভিত্তি আছে, অনেক সহযোগী সংগঠন আছে। তাদের সব নেতাকর্মী ভোট দিলেও নৌকার প্রার্থী অন্তত ৪০ হাজার ভোট পেতেন৷ ভোটগুলো গেল কোথায়? সেখানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পাঙ্খা গজালো কীভাবে? হাতপাখার এতো ভোট পাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই অলৌকিক কিছু নেই।

২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রায় ১ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেনে জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের সরফুদ্দীন আহমেদ পান ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। আগের নির্বাচনের চেয়ে এবার প্রায় ৪০ হাজার ভোট কম পেয়েছে নৌকা। রংপুরে নৌকার ওই নিজস্ব ভোটগুলো গেল কোথায়?

এর আগে ২০১২ সালের ২৮ জুন গঠন হয় রংপুর সিটি করপোরেশন। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রথম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী (জাপা থেকে আওয়ামী লীগে যাওয়া) সরফুদ্দীন আহমেদ জেতেন ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোটে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির বিদ্রোহী প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান। তিনি পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট।

এবার রংপুরে মেয়র হবেন লাঙ্গলের, দ্বিতীয় হবে নৌকা—এমন ধারণা আগে থেকেই ছিল অনেকের মাঝে। কিন্তু সব ধারনা ও হিসাব উল্টে নৌকা তৃতীয়ও হলো না, হলো চতুর্থ। তাও জামানত হারিয়ে। কেবল রংপুর নয়, সারা দেশের আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে এটি একটি অন্যরঙের বার্তা। জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নৌকার এমন ফলাফলে তারা হতভম্ব-বিস্মিত। ক্ষুব্ধও। কোনো সমীকরণ ও যুক্তিতেই হিসাব মিলছে না তাদের। লাঙ্গলের মোস্তাফিজার রহমানের কাছে লক্ষাধিক ভোটে কীভাবে হারেন নৌকার হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া।

এ পরাজয়ের চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে নৌকার ভোটের সংখ্যা নিয়ে। নৌকা পেয়েছে ২২ হাজার ভোট, আর হাতপাখার আমিরুজ্জামান প্রায় ৫০ হাজার। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমানও নৌকার চেয়ে ১১ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। হোসনে আরা নিজ কেন্দ্র জি এল রায় রোডে লায়নস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রেও হেরেছেন। এই কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৯২ ভোট।

এর অর্থ এই নয় যে সারা দেশ রংপুর হয়ে গেছে। আবার রংপুর সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্নও নয়। তবে বর্তমান-ভবিষ্যতের ভাবনার অনেক খোরাক দিয়েছে রংপুর। নির্বাচনী প্রচারকালে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকাকে উন্নয়নের প্রতীক বলেও জানান দিয়েছেন। উন্নয়ন চাইলে নৌকায় ভোট দিতে হবে— এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেওয়া হয়েছে। সেখানে নৌকা কেবল ডোবেইনি, জামানতও বরবাদ হয়ে গেছে।

আর পাঙ্খার ঝাপটানি তো নতুন যোগ। এখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে সামাজিক উপন্যাস নৌকাডুবি একটু হলেও প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। ১৩১০-১১ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত নৌকাডুবি উপন্যাসের রমেশ, হেমনলিনী, ক্ষেমংকরী, কমলা, নলিনাক্ষ, অন্নদাবাবু, যোগেন্দ্র, অক্ষয়, শৈলজ, উমেশ ইত্যাদি পারিবারিক চরিত্রগুলো আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও চরিত্রের সঙ্গে কীভাবে যেন কিছু কিছু মিলে যায়। নিরীহ বিরোধী দলের মামুলি কর্মসূচিতেও নৌকাডুবির ষড়যন্ত্র খোঁজা, গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরি করে 'গুডবয় পলিটিক্স' নিশ্চিত করে গণতন্ত্র দেখানো, দলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও আশপাশের সুবিধাভোগীদের দিকে দৃষ্টি না দেওয়ার পরিণামের প্রচুর পাঠ-পঠন রয়েছে কবিগুরুর নৌকাডুবিতে।

নির্বাচন–গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস দেখালে বরং তা কম ডোবার আশা অবশিষ্ট থাকতেও পারে। হোক তা পিত্রালয় বা শ্বশুরালয়, যে কোথাও। রংপুর-ফরিদপুরে হেরে বা কুমিল্লায় জিতেও। ভারসাম্য-সমতল রচনায় অনেক অসাধ্যও সাধনে চলে আসে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Freedom declines, prosperity rises in Bangladesh

Bangladesh’s ranking of 141 out of 164 on the Freedom Index places it within the "mostly unfree" category

2h ago