‘মেইড ইন বাংলাদেশে’র নেপথ্যজনেরা

‘কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেধা ও মননের বুননে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই বিশ্বে বাংলাদেশের নামে। মেইড ইন বাংলাদেশ। মেইড ইন বাংলাদেশ।’
ছবি: ফারিয়া রহমান বৃষ্টি

'কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেধা ও মননের বুননে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই বিশ্বে বাংলাদেশের নামে। মেইড ইন বাংলাদেশ। মেইড ইন বাংলাদেশ।'

এটা 'মেইড ইন বাংলাদেশ উইক ২০২২' এর গানের অংশ। এভাবেই কথা ও সুরে রপ্তানির শীর্ষখাত এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশের উদ্যোক্তা প্রতিনিধি বিজিএমইএ ২০২২ সালের শেষভাগে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সপ্তাহে ব্যবসায়িক উন্নতির জয়গান তুলে ধরে।

প্রায় ১৬০টি দেশের ৫৫০ জন ক্রেতা প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন এই আয়োজনে। এই আয়োজন ঘিরেই এই বিশেষ প্রচারণা গান।

গানটির দৃশ্যায়নে শিল্পী ছাড়াও হাজারো শ্রমিক অংশ নেয়। গানে গানে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি, সমৃদ্ধি, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা শুনতে ও ভাবতে নাগরিক হিসেবে যে কারোরই ভালো লাগবে।

গানটিতে ব্যবসার কৌশল হিসেবে এ খাতের সামর্থ্য তুলে ধরা ও ব্র্যান্ডিংয়ে পণ্যের গুণগানের সঙ্গে দেশাত্মবোধ ও ভালোবাসার মতো যুক্ততার সামাজিক উপাদানের বীজ বোনার সুনিপুণ চেষ্টা দেখা যায়। পণ্যের গুণগানের সঙ্গে মূল্যবোধও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে এমন গীতিকার বাছাই এবং এ খাতের এমন উপস্থাপন নিশ্চয়ই  বিজিএমইএর নেতৃত্বের পরিপক্বতারই পরিচয়।

কিন্তু, ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিণত রূপ নেওয়া এই খাতের পেছনের অন্যতম কারিগর পোশাক শ্রমিকরা বাস্তবে কেমন আছে? চলমান ও সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির কী প্রভাব তাদের জীবনে? রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের আয় কতটা বেড়েছে? সেসব চিত্র এ আয়োজনে উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায় না। ব্যবসায়িক উন্নতির মেগা ইভেন্টে শ্রমিকের জীবনমানের 'উন্নতি'র ভাবনা কার্পেটের নিচেই থাকে।

'আপন মহিমায় ছড়িয়েছি লাবণ্য, পোশাক শিল্পে আজ আমরাই অনন্য' মেগা আয়োজন প্রচারণা গানে এমনি কথাও বেজে উঠে। যেন শ্রমিকরাও সুখের বন্যায় ভাসছে। এটা সত্য যে, গানের কথা মতো তারুণ্যের সব লাবণ্য মেশিনের চাকায় চাকায় নিরলস ছড়ায় ৪০ লাখ তরুণ শ্রমিক। কিন্তু কাজ করতে করতে সেই লাবণ্য কতটুকু আবারও ফিরে পায় তারা? কত ক্যালোরি শক্তি নিজেদের জন্য প্রতিদিন পুনরায় উৎপাদন করতে পারেন? খাদ্যাভ্যাসে সুষম কিংবা প্রোটিন খাবার রাখার কতটা সামর্থ্য আছে?

শ্রমিক থেকে একজন সাবিনা যখন এশিয়ান উইমেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হন, অভয়া উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তখন নিশ্চয়ই আমরা গর্বিত হতে পারি। কিন্তু লাখো সাবিনা শিক্ষা থেকে ছিটকে পুষ্টিহীন-ছুটিহীন-বিরামহীন জীবনে 'সস্তা' শ্রমিক হিসেবে পরিচিত। গ্রাজুয়েট সাবিনা আর ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের জীবন কি এক? লাখো শ্রমিকের ৮ হাজার টাকার মজুরিতে বাজার থেকে বর্তমানে কী কী কেনা সম্ভব? মালিকের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সব শ্রমিকের জীবনমান ও দক্ষতা বিকাশে কি মেগা পরিকল্পনা আছে বিজিএমইএর নেতৃত্বের? এই খাতের বিকাশকে কি কেবল মালিক-বায়ারের প্রাপ্তি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, কারখানার দালান-কোঠার উন্নয়ন বা সবুজে ঘেরা কারখানার দেয়ালের মধ্যেই দেখার সুযোগ আছে? রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে তাকে কি পুরো খাতের উন্নয়ন বলা যায়?

আমরা জানি, এ খাতের উন্নয়ন পোশাক শ্রমিকদের জীবনমানের প্রশ্ন অত্যাবশ্যিক ও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। চাইলেও যা উপেক্ষার সুযোগ নেই। 'উন্নয়নে'র হিস্যায় শ্রমিককে ভাগীদার না করে কোনো সংজ্ঞা, বয়ান বা পরিকল্পনা রচিত হলে সেটা অসম্পূর্ণ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

তাই উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে এবং বিদায় নেওয়া ২০২২ সাল শ্রমিক ও মালিকের জন্য কেমন ছিল তা জানতে পাঠককে নিয়ে কল্পনার জগত থেকে বের হতে চাই। কোনো মনগড়া বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সুবিধার প্রচারণার ফানুসে নয়, হাঁটতে চাই বাস্তব জমিনে। ইতিহাসে ও মূলধারায় যাদের গল্প প্রায়শই চাপা পড়ে, নিজেদের প্রাণ পুষ্টি ও লাবণ্য বিসর্জন দিয়ে যারা বাংলাদেশের নাম দুনিয়ায় পরিচিত করেছে এবং  এতো উন্নতি নিয়ে এসেছে, সেই তরুণ শ্রমিকের অবস্থা জানতে চাই। বছর শেষে কষতে চাই তাদের জীবনমান নিয়ে হিসাব-নিকাশ। উদ্যোক্তাদের সাফল্য কতদূর গড়িয়েছে সেটিও পরখ করতে চাই।

ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও নিঃসন্দেহে ২০২২ সাল উদ্যোক্তাদের জন্য ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য সময়। এই বছরে বাংলাদেশ ৫১ বছরে পার করেছে। সময়টা ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটে জর্জরিত। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এই বছর। সঙ্গে ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। দেশে-বিদেশে সকলের জীবনে যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু শত সংকট পেরিয়ে পোশাক খাতের ব্যবসায়িক উন্নতির গল্পই বারবার ফাঁক-ফোকর দিয়ে কানে এসেছে বছর জুড়ে।

বছরটা ছিল পোশাক শ্রমিকের পূর্ববর্তী মজুরি ঘোষণার ৪ বছর পার হওয়ার কাল। যেখানে বাজারের বেহাল দশা এবং মালিকপক্ষের উন্নয়নে সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে। যখনই মজুরি বৃদ্ধি কিংবা শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি সামনে এসেছে, তখনই শুনেছি মালিকপক্ষের অভাব আর অভিযোগ। প্রতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো যখন পোশাকখাতে আয় বৃদ্ধির কথা বলেছে, ততবার মালিকপক্ষ সেটা স্বীকার করেও পরক্ষণেই বলেছে, আত্মতুষ্টির কারণ নেই, সামনেই বিপদ, শঙ্কা-সংশয়, আগামীতে সুদিন নাও থাকতে পারে— এমনি নানা বিপদ সংকেতের কথা।

বিপদ কখনোই ছিল না বা নেই, বিশ্ব অর্থনীতিতে তেমনটা নয়। কিন্তু এই খাত মালিকপক্ষের ৪০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা এবং সকল বিপদের ধকল শ্রমিকের কাঁধে রেখে মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট পরিপক্ব, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৩ সালে রানা প্লাজার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে ১ হাজার ১৭৫ জনেরও বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। সেই সময় মালিকপক্ষ যেভাবে নিজেদের দায়কে শিক্ষানবিশ বা অপরিণত পর্বের দোহাইয়ে পার করতে পেরেছে, ২০২২-২০২৩ এ সেই সুযোগ নেই।

গত ৯ বছরে ব্যবসায়িক সামর্থ্য কতটুকু বেড়েছে, সেটা ২০২২ সাল জুড়ে সরকারি তথ্য ও আন্তর্জাতিক নানা তথ্য থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বরাবরের মতো প্রত্যেক সময় তারা নিজেদের সামর্থ্য বাড়ালেও, শ্রমিকদের বিপদের মধ্যেই ফেলে রেখেছিল। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার ধাক্কায় আর সবাই স্ব-বেতনে ছুটি পেলেও শ্রমিক কাজে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বাড়তি প্রণোদনা কিংবা জরুরি তহবিলের সুযোগ পাওয়ার বদলে ৩ লাখ শ্রমিক কাজ হারান, ছাটাই ও লেঅফ হয়। প্রণোদনাতো দেওয়াই হয়নি, উল্টো শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট বন্ধের প্রস্তাব দেয় মালিকপক্ষ।

করোনার ধাক্কা শেষে বাংলাদেশে কার্যাদেশ আসতে থাকে, পত্রিকা জুড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, দেশে বন্যার প্রভাব ইত্যাদিতে আবারও নাজুক দশায় পড়ে শ্রমিক। অতীতেও দেখা গেছে, বিপদ মোকাবিলা করে বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই খাতের উদ্যোক্তারা। সুদিন তাদের দোর গোঁড়ায় এসেছে ঠিকই। যদিও এই সুদিনের বাতাস শ্রমিক পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছায়নি। ২০২২ সাল ছিল তাজরীনে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ১০ বছর, আর রানা প্লাজার ৯ বছর। অথচ এখনো দোষীদের শাস্তি হয়নি। যথাযথ বদল হয়নি ক্ষতিপূরণ আইনের।

অন্যদিকে মেইড ইন বাংলাদেশ উইক, নতুন নতুন বাজার সীমানা বৃদ্ধি, ৫০ এর সীমা পেরিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের শিল্প উন্নয়নের স্বপ্ন, ১৭৩টি সবুজ কারখানাসহ বিশ্বের নিরাপদতম সবুজ কারখানার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি, জলবায়ু অভিঘাত বিবেচনায় টেকসই উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০ লক্ষ্য নির্ধারণসহ বছর জুড়ে নানা আয়োজন। এর সবই এ খাতের অবনতি নয়, উন্নতিরই চিহ্ন।

সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২০২২ সালের নভেম্বরে ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে রেকর্ড করেছে। এই রেকর্ড স্বাধীনতার পর এটাই প্রথম। ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বরে ৫ মাসে পোশাক খাতে রপ্তানি মূল্য ১ হাজার ৮৩৪ কোটি ডলারে পৌঁছে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরের এই তথ্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বরাত দিয়ে পত্রিকাগুলো ফলাও করে প্রকাশ করেছে।

২০২২-২০২৩ সালের রপ্তানি মূল্য ২০২১-২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় শতকরা ১৫ ভাগেরও বেশি বেড়েছে। এর কোনোটাই আষাঢ়ে গল্প নয়। কিন্তু এই সাফল্য কিংবা পরিপক্বতা কী কেবল মালিক-বায়ার ও সরকারের সুবিধার জন্য নিবেদিত? শ্রমিকদের বছর জুড়ে বাজারের সঙ্গে নিদারুণ নিষ্ঠুর বেঁচে থাকার লড়াই বলে এই পরিপক্বতার ভাগীদার শ্রমিক নন?

এতসব বলতে গিয়ে রোকেয়ার কথা মনে পড়ে গেলো। ১৪২ বছরের আগে ১৮৮০ সালে এই অঞ্চলের নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়ার জন্ম হয় রংপুরের পায়রাবন্দে। তিনি তার রচনা 'চাষার দুঃখ' এবং 'এন্ডি শিল্পে' দেখিয়েছিলেন মুষ্টিমেয় ধনীর উন্নতিই যে দেশ ও জাতির উন্নতি নয়, সেই বিষয়টি। চাষা বা মজুরদের 'গোয়াল ভরা ধান কিংবা গোয়াল ভরা গরু' ছিল না, বরং দুর্দশার মধ্যে নিপতিত ছিল, সে দিক তুলে ধরেছিলেন। যেমনটা বর্তমান শক্ত সামর্থ্য পোশাকখাতে উন্নত বাংলাদেশে, ডিজিটাল বাংলাদেশে, স্মার্ট বাংলাদেশে কিংবা উন্নয়নের সোপানে এগিয়ে চলা বাংলাদেশেও শ্রমিকদের জীবনে দেখি। কিন্তু ওই সময় রোকেয়া তৎকালীন চাষা-মজুরের দুঃখ দূর করার পথ হিসেবে দেশীয় বাজার, দেশীয় শিল্প ও নারী শিল্প উদ্ধার,  গ্রামে গ্রামে পাঠশালা ও চরকা এবং চাষা-মজুরের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

ফিরে আসি ২০২২ সালে। রপ্তানির এতো এতো উন্নয়নের গল্পের সামনে পোশাক শ্রমিকরা যখন নিজের হিস্যা দাবি করেন, তখনই শুনি অন্য কথা। মালিকরা তখনই নানা অজুহাত জুড়ে বসেন। কোনো বিপদেই তারা শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। করোনাকাল থেকে মূল্যস্ফীতির কালে তার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। এমনকি ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে শ্রমিকরা যখন মিরপুর, গাজীপুর কিংবা উত্তরাসহ নানা শ্রমিকাঞ্চলে থেমে থেমে মজুরি বৃদ্ধির দাবি করেছে, তখন তাদের দাবি তো মানাই হয়নি, উল্টো তাদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতন।

মন্ত্রী মহোদয় শ্রমিকদের শান্ত করতে মজুরি বোর্ড গঠন করার আশ্বাস দিয়েছেন। মালিক-সরকারের কেউ কেউ আন্দোলনকে বলছেন, 'ষড়যন্ত্র' বা 'উস্কানি'। সরকার প্রধানও হুঙ্কার দিয়েছিলেন, 'আন্দোলনের কারণে কারখানা ও রপ্তানি বন্ধ হবে, তখন আম-ছালা দুটোই যাবে শ্রমিকদের। বেতন তো বাড়বে না বেতনহীন হয়ে যেতে হবে।'

ইউরোপ ও আমেরিকা যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে কাপড় কিনছে কম। মালিক-সরকারের অনেকে বলছেন, এ অবস্থায় আন্দোলন হলে দেশ থেকে শিল্প নাকি অন্য দেশে চলে যাবে। এ যেন সেই পুড়নো জুজুর ভয়।

কিন্তু কে না জানে, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোই বলছে বর্তমান সংকটের বাজারে অন্যসব রপ্তানিখাতে আঘাত আসলেও পোশাকখাত এগিয়ে যাচ্ছে। জাপান, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশে উৎপাদিত দ্রব্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, যা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এর আগে চিলি, ব্রাজিল, মেক্সিকো, আফ্রিকা ও রাশিয়াতেও নতুন বাজারের বিস্তার ছিল।

রাশিয়া ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশগুলোতে রপ্তানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ভারতে ১৯ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৯ শতাংশ বেশি। এই ধারায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় জুলাই-আগস্টে রপ্তানি হওয়া ৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে জাপানে ৬০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সে হিসাবে জাপানে রপ্তানি বেড়েছে ৩৮ শতাংশেরও বেশি।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) অপ্রচলিত বাজরে পোশাক রপ্তানি ২৪৭ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ৩১৯ কোটি ডলার হয়েছে। এ ছাড়া, মালয়েশিয়ায় ১০০ দশমিক ২১ শতাংশ, মেক্সিকোয় ৪৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ভারতে ৪৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ব্রাজিলে ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩০ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। কেবল রাশিয়ায় যুদ্ধ প্রভাবে ৫০ দশমিক ৫৩ শতাংশ রপ্তানি কমেছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ৭৮১ কোটি ডলার থেকে ৯০৭ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। একই সময়ে ২০২২ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪৭ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। যুক্তরাজ্য ও কানাডায় রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রম ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ ও ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা সংকট, দেশে দুর্ভিক্ষের জুজু, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিল পরিস্থিতিতে যখন দেশ বেহাল দশায়, তখন পোশাক শিল্পের এ ধরনের সুখ্যাতি ও তথ্য পোশাকখাতকে টেকসই শিল্প হিসেবেই বার্তা দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরও ২০২২ সাল পর্যন্ত কোনো মজুরি বোর্ড গঠিত হয়নি। কখনোই শ্রমিকদের বিপদকালীন সময়ের জন্য মালিকরা তহবিল জন্য করেনি। না করোনাকালে, না দেশীয় ও আন্তর্জাতিক টালমাটাল সময়ে।

দেশীয় অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার দায় নিতে বরাবর আবদার আসে পোশাক শ্রমিকদের কাছে। কিন্তু যখন লাভের জোয়ারে মালিকরা ভাসেন, তখন আর সেই লাভের ভাগীদার তারা হতে পারেন না। লাভ হলে তা ব্যক্তিগত, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি হলে তা সামাজিক দায়— উদার অর্থনীতির এমনি ধারা বাংলাদেশের পোশাকখাতেও দেখা যায়।

২০২২ সাল জুড়ে দেশীয় বাজারে ছিল টালমাটাল দশায়। ওএমএসের ট্রাকের পিছনে দৌড়ানো কিংবা লম্বা লাইনের নিষ্ঠুর দৃশ্যই বলে জনগণ দুর্দশার কথা। এই বাজারে মাছ, মাংস, ফল, দুধ, মাখনের কথা বাদ দিয়ে কেবল চাল-ডাল-আটা-নুন-তেল-ডিমের হিসাব দেখলেই বোঝা যায়, শ্রমজীবীসহ দেশের মানুষ কী বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। প্রতিদিনের বাজার কাটছাঁট করে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছে সবাই। এই অবস্থায় পোশাক শ্রমিকের অবস্থা যে কতটা শোচনীয়, তা বুঝতে বাকি থাকে না।

২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা করা হয় এবং তা কার্যকর হয় ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বরে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বাজারে ২০১৮ সালে চালের দাম ছিল ৪৪-৫৪ টাকা, যা ২০২২ সালে হয়েছে ৫২-৬০ টাকা। চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। একইভাবে ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৯৭ শতাংশ, আটার দাম ১২০ শতাংশ, সয়াবিন তেলের বোতল ৮৬ শতাংশ, চিনির দাম ১১৪ শতাংশ।

ডিমের দাম ২০২২ সালে দফায় দফায় বেড়ে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা হালি হয়েছে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের আগস্টে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। ফলে তখন থেকেই নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে দফায় দফায়। পরিবহনসহ সবখাতে খরচ বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ১১ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ। বাস্তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি আরও বেশি।

এই যখন বাজারের হাল, তখন ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে পোশাক শ্রমিকদের বেতন কিন্তু ৮ হাজার টাকাতেই আটকে আছে। বুঝতে বাকি থাকে না, পোশাক শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা কেমন। গত ৫ বছরে শুধু এই কয়টি পণ্যের বাজার দর লাগাম ছাড়া বৃদ্ধি বলে দেয়, শ্রমিকের মজুরি পূনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।

অথচ মালিকের উন্নয়নের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে মজুরি বৃদ্ধির কথা বললেই শুনতে হয়, ব্যবসা এখন কোনো রকম চললেও 'সামনে বিপদের আশংকা'। লাভের ভাগ শ্রমিক না পেলেও ক্ষতির ভাগ সামষ্টিকভাবে শ্রমিকের কাঁধে চাপানোর কৌশলই চালু আছে।

রোকেয়া যখন চাষার দুঃখ লিখছেন, তখনও ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ কৃষকের দুর্দশার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। রোকেয়া বলেছিলেন, ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ তো এই ৭ বছরের ঘটনা, ৫০ বছর আগেও কি চাষার অবস্থা ভালো ছিল? রোকেয়ার লেখার একটা অংশ চাষার জায়গায় শ্রমিক লিখে পড়তে পারি। রোকেয়ার বিদ্রূপের ভাষাই যেন শ্রমিকদের জন্য মালিক-সরকার এবং বায়াররা বেদবাক্য হিসেবে নির্ধারণ করেছেন— 'এ কঠোর মহীতে শ্রমিক (চাষা) এসেছে শুধু সহিতে। আর মরমের ব্যথা লুকায়ে মরমে জঠর অনলে দহিতে!!'

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা আর শ্রমিককে কেবল সয়ে যেতে দেখতে চাই না। যেকোনো অর্থনৈতিক সংকটে যে শ্রমিক এমনিতেই পুষ্টিহীন জীবনযাপন করে, তাকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার মতো নিদারুণ তামাশা কোনোভাবেই মানা যায় না। সংযম যদি করতে হয়, তাহলে যারা ভোগ বেশি করেন, তাদেরকে সংযমী করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তৈরি করতে হবে বিশেষ জরুরি তহবিল। শ্রমিকের সংকট মোকাবিলায় নীতি-কাঠামো তৈরিসহ মালিক-সরকার-বায়ারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে। জরুরি তহবিল গঠন করতে হবে। কারখানায় এবং সর্বত্র ভয় ও নিপীড়ন মুক্ত গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

সক্ষমতা কেবল রপ্তানির হার বা মালিকের আয় বাড়িয়ে নিশ্চিত করলেই হবে না। বায়ারদের সঙ্গে দরকষাকষির সক্ষমতাও একইসঙ্গে বাড়াতে হবে শ্রমিকদের সামর্থ্য ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে। শ্রমিকের বাঁচার মতো মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে শ্রমিক তার লাবণ্য, উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা ধরে রাখতে পারেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন নিপীড়নমূলক নীতিমালা সেল এবং অন্যান্য সুযোগ নারীদের জন্যও রাখতে হবে, যাতে অটোমেশনের ধাক্কায় নারী শ্রমিক ঝরে না পড়ে। শ্রমিকের মজুরি বাড়লে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, অর্থনীতিও গতি পাবে।

রেশন, মহার্ঘভাতা, জীবন বিমা, পেনশন, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থার মতো জরুরি ব্যবস্থা বর্তমান সময়ে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের জন্য দরকার।

সম্প্রতি শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো নতুন মজুরি বোর্ড গঠন ও ২৫ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের যুক্তিসঙ্গত দাবি তুলেছে। কারণ শ্রমিকের জীবনমান না বদলে, দুর্দশায় রেখে কেবল রপ্তানি বা মালিকের আয় বাড়লে কিংবা শ্রমিকের স্বার্থে আইন ও প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন না থাকলে, কথা বলার অধিকার না থাকলে, নিজের মাটিতে কিংবা বিশ্ব দরবারে কোথাওই মাথা উঁচু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় না। উল্টো মাথা নিচুই হয়।

আমাদের দেশে পোশাকখাত নিয়ে মাথা উঁচু করতে হলে মালিক-বায়ার-সরকার, ৩ পক্ষকেই দায় নিতে হবে। বর্তমান সময়ের উদ্যোক্তারা পরিপক্বতার পরিচয় তখনই পূর্ণভাবে দেবেন, যখন শ্রমিকদের জীবনমান, মজুরি ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন। তখন 'মেইড ইন বাংলাদেশ'র নেপথ্যজন পোশাক শ্রমিকরা পর্দার আড়াল থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে আসবে।

তাসলিমা আখতার; সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি এবং আলোকচিত্রী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Rain drenches Dhaka amid heatwave

The city dwellers got some relief after rain drenched Dhaka amid ongoing heatwave across the country today

1h ago