বিএনপির নির্বাচনে আসা কি অনিশ্চিত

কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক—

কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক—

১. বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে: কাদের; দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ জানুয়ারি ২০২৩

২. শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করা হবে: কৃষিমন্ত্রী; বাসস, ৭ জানুয়ারি, ২০২৩

৩. বিএনপি না এলেও নেতারা ঠিকই ভোটে আসবে: হাছান মাহমুদ; বিডিনিউজ, ৬ জানুয়ারি ২০২৩

এই সংবাদ শিরোনামগুলো পড়ে যে প্রশ্নটি মাথায় আসছে তা হলো, আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া কি অনিশ্চিত? প্রশ্নটা আসছে এ কারণে যে, বিএনপি এখনো বলছে এবং তারা মূল যে দাবিতে অনঢ় তা হলো, নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন— যেটি বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যদি সংবিধান সংশোধন করা না হয় এবং যদি আগের দুটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, তাহলে কি বিএনপি নির্বাচন বয়কট করবে, যেমনটা করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে?

ওই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছিল? এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও মাত্র ৬টি আসনে জয় পায়। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সঙ্গে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের সময় সরকারপ্রধান হিসেবে কে থাকবেন— সেটিই এখন বিএনপির প্রধান বিবেচ্য।

নানা কারণেই দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে প্রায় নিষ্প্রভ হয়েছিল বিএনপি। কিন্তু গত বছরের শেষদিকে দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। বিশেষ করে বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশে বিপুল মানুষের সমাগম এবং সবশেষ গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় তাদের সমাবেশকে ঘিয়ে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাতে বোঝা যাচ্ছে আগামী দিনগুলোয় বিএনপি হয়তো দাবি আদায়ে আরও বেশি তৎপর হবে। কিন্তু মূলধারার প্রতিটি দলেরই প্রধান লক্ষ্য সরকার গঠন। সরকার গঠন করতে হলে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে।

গত ৭ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। অস্তিত্বের জন্য নির্বাচনে আসতেই হবে।' তার ভাষায়: নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, অবাধ হবে। একই দিন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'নির্বাচনে কে অংশগ্রহণ করল, আর কে করল না, তাতে কিছু যায় আসে না। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করব বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য।'

প্রশ্ন হলো, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে বলছেন বিএনপি শেষমেশ নির্বাচনে আসবে, সেটি কি সত্য হবে? বিশেষ করে বিএনপি যখন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অনঢ়— সেই বাস্তবতায় যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়, বিএনপি কি সেই নির্বাচনে আসবে?

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৬ সালে যখন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল, তখন এই দাবিতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ যা যা বলেছিল, বর্তমান বিরোধী দল বিএনপিও সেটি বলছে। আবার ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল বিএনপি যা যা বলেছিল, এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও মোটামুটি সেসব কথাই বলছে। তার মানে বিরোধী দলে থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক ভালো, আর সরকারি দলে থাকলেই সেটি খারাপ।

অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের ৩ মাস আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং ওই স্বল্প সময়ের জন্য একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিধান নিয়ে ১৯৭২ সালে গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়েই আলোচনা হয়েছিল। ওই বছরের ২ নভেম্বর আইন ও সংসদ বিষয়াবলি এবং সংবিধান প্রণয়নমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, যিনি সংবিধান প্রণয়নে গঠিত ৩৪ সদস্যের কমিটিরও সভাপতি ছিলেন, তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল আজিজ চৌধুরীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, 'সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম হলো যে, মন্ত্রিসভা ভেঙে যাওয়ার ফলে ৯০ দিনের জন্য যে কেয়ারটেকার সরকারের নিয়ম আছে, সেই সরকার সেই ৯০ দিনের মধ্যে কোনোরকম মৌলিক নীতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। সব দেশেই এই নিয়ম পাওয়া যাবে।' (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৭১৮)।

সুতরাং যদি নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে প্রধান ২ দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে কি না— সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। তা ছাড়া রাজনৈতিক অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই অরাজনৈতিক শক্তি যে ক্ষমতা দখল করে, সেটি বারবার প্রমাণিত এবং কোনো অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে যে কী পরিণতি হয় এবং দেশ ও দেশের মানুষকে যে কীভাবে এর মূল্য দিতে হয়, তা দেশবাসী জানে। সুতরাং সেরকম পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য প্রধান ২ দলকেই সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে বিরোধী পক্ষের চেয়েও ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব অনেক বেশি।

সব মিলিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির আসা না আসা বেশ কয়েকটি 'যদি কিন্তু'র ওপর নির্ভর করছে। যেমন: তারা যদি এটা বুঝে যায় বা নিশ্চিত হয়ে যায় যে নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে হচ্ছে এবং আগের ২টি নির্বাচনের মতোই সেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে— তাহলে বিএনপি হয়তো নির্বাচনে আসবে না এবং তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেবে। আবার যদি সরকার বা সরকারি দলের সঙ্গে আসন বণ্টন বিষয়ে তাদের কোনো গোপন সমঝোতা হয়, সেক্ষেত্রে নির্বাচনে এসে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারে। কেননা বিএনপি এখনো মনে করে যে, আগামী নির্বাচনও সরকার 'নিজের মতো' করবে।

প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচনও যদি সরকারের 'নিজের মতো' করে হয়, হলে কি বিএনপি ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করবে নাকি প্রতিহত করবে? নির্বাচন বয়কট করলে কার লাভ কিংবা আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি কি বিএনপির আছে?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

13h ago