কাচ্চিতে কুকুরের মাংস: অবিশ্বাসের বাস্তবতা
পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ কুকুরের মাংস খেলেও বাংলাদেশের মানুষ খায় না। ফলে যখন কোনো রেস্টুরেন্টের কাচ্চি বা বিরিয়ানিতে কুকুরের মাংস পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ কিংবা গুজব ওঠে, তখন সেটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করে—যে সংকট ত্বরান্বিত করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সেই ইস্যুতে কিছু মৌলিক প্রশ্নও সামনে আসে।
যেমন: রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বড় বড় বাজারে প্রতিদিন বিক্রির জন্য আনা যেসব মুরগি জবাই করার আগেই অসুস্থতা বা নানা কারণে মারা যায়, সেসব মুরগির গন্তব্য কোথায়; ময়লার ভাগাড় নাকি রেস্টুরেন্ট? এই অভিযোগও বেশ পুরোনো যে, বাজারের মরা মুরগিগুলোও প্রসেস হয়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট চলে যায়। এই অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন এই অভিযোগগুলো ওঠে এবং মানুষ এই ধরনের অভিযোগ বা গুজব বিশ্বাস করে কেন? ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে তাদের এই আস্থাহীনতা বা আস্থার সংকটের বাস্তবতা কী এবং এসব অভিযোগ বা গুজব প্রতিরোধে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ভূমিকা কতটা সক্রিয়?
সবশেষ বিতর্কটি উঠেছে দেশের একটি পরিচিত রেস্টুরেন্টকে নিয়ে যে, সেখানে তৈরি হওয়া কাচ্চিতে কুকুরের মাংস পাওয়া গেছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, এটি কি অভিযোগ না গুজব? যদি গুজব হয়, তাহলে কারা গুজবটি ছড়ালেন এবং তাদের উদ্দেশ্য কী? আর যদি এটি গুজবও হয়, তারপরও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দায়িত্ব কী এবং তারা সেই দায়িত্বটি পালন করেছে কি না? শুধু একটি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধেই যে এই গুজব বা অভিযোগ উঠল তা নয়, বরং এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের খবর বা গুজব সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে কুকুরের মাংস বিক্রির দায়ে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তার মানে অভিযোগগুলো যে সব সময় মিথ্যা, সেটিও নয়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সবশেষ অভিযোগ উঠলো যে, 'সুলতানস ডাইন' নামে একটি রেস্টুরেন্টের কাচ্চি বিরিয়ানিতে খাসি বলে কুকুর বা অন্য প্রাণীর মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে এই রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা এই রেস্টুরেন্টের কর্তৃপক্ষের কাছে কাচ্চিতে দেওয়া মাংস কোথা থেকে আনা হচ্ছে বা মাংস সংগ্রহের বিষয়ে তথ্য জানতে চায়। কিন্তু তারা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের লোকজনও সেখানে গিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো কুকুর, বিড়াল বা গবাদি পশুর বাইরে অন্য কোনো প্রাণী ধরে সেগুলো জবাই করে মাংস প্রসেস করে কাচ্চি বা বিরিয়ানি রান্নার যে হ্যাপা ও ঝুঁকি, তার চেয়ে গরু-মহিষ-খাসি-ছাগলের মাংস কিনে প্রসেস করে রান্না কি অনেক সহজ নয়? তা ছাড়া যেসব রেস্টুরেন্ট জনপ্রিয় এবং প্রচুর চলে, সেখানে কি ব্যবসায়ীরা এই ধরনের ঝুঁকি নেবেন? আবার কুকুর ধরে জবাই করে মাংস প্রসেস করতে হলে সেই প্রক্রিয়ায় একাধিক লোককে জড়িত থাকতে হয়। কারো না কারো চোখে কি এটা পড়বে না? কেউ না কেউ কি এটা প্রকাশ করে দেবেন না? এখন প্রান্তিক মানুষের হাতেও স্মার্টফোন আছে। ইন্টারনেট আছে। সুতরাং কুকুর-বিড়াল ধরে জবাই করে তার মাংস প্রসেস করে রেস্টুরেন্টে সরবরাহ কি খুব সহজ কাজ?
যদি সহজ না হয়, তাহলে এই অভিযোগ, গুজব বা বিতর্কটি বারবার কেন ওঠে? ওঠে কারণ কিছু বাস্তবতা আছে। কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন: এই বিতর্ক নিয়ে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আমাকে মেসেঞ্জারে লিখেছেন, 'কুকুর নিধন নিষিদ্ধের পরের ২ বছর কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধিতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একটা কুকুর ৫-৬টা বাচ্চা দেয়। সে হিসাবে গত ৪-৫ বছরে রাজধানীর পাড়া-মহল্লা কুকুরে সয়লাব হওয়ার কথা। কিন্তু গত ২-৩ বছরে কুকুরের সংখ্যা তেমন বাড়েনি। কুকুরগুলো কি দেশান্তরি হয়েছে নাকি জন্মনিয়ন্ত্রণ করছে? তাহলে কুকুর নিধন নিষিদ্ধের সময়ে কুকুরের বংশবৃদ্ধি কম কেন?' এটি একটি প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নটি ধরে অনুসন্ধান হতে পারে।
কাচ্চিতে কুকুরের মাংস বিতর্ক নিয়ে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, 'বড় বড় রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন অনেক মাংস দরকার। ধরা যাক কোনো কোনো রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন ১০০ কেজি খাসির মাংস দরকার। তার ভেতরে যদি ১০ কেজি কুকুরের মাংস ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে একদিনেই অতিরিক্ত লাভ কত?' আরেকজন লিখেছেন, 'বিচারহীনতার দেশে সবই সম্ভব।'
কলকাতার সাংবাদিক শুভজিৎ ফেসবুকে লিখেছেন, 'ঢাকার ঘটনাটি সত্যি কি না জানি না, তবে কলকাতায় এরকম ঘটনা দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। মৃত গরু, শুয়োর তো সাধারণ ব্যাপার। ধেড়ে ইঁদুর থেকে মৃত পোষ্য কুকুর, কিছুই বাদ যায়নি। মৃত জীবজন্তু বিভিন্ন ভাগাড় থেকে সংগ্রহের পরে প্রসেস করে চালান করা হতো নামি-দামি হোটেলে। তারাও যে সব জানত, এমন নয়। সব থেকে বেশি এমন রোটেন মিট বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত কলকাতার নিউ মার্কেট চত্বরে। পুলিশের কড়া পদক্ষেপের পরে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে এমন মাংস রাখার কোল্ডস্টোরেজও পাওয়া যায়। প্রায় ২০০ টন এমন মাংস উদ্ধার হয় সেখান থেকে।' শুভজিৎ লিখেছেন, 'আমি নিজেও ভুক্তভোগী। পেট্রাপোল সীমান্তের কাছেই হোটেলে কুকুরের বিরিয়ানি খেয়ে বসে আছি।'
তার মানে এসব অভিযোগ, গুজব কিংবা বিতর্কের পেছনে কিছু কারণও আছে। কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। হয়তো খুব সামান্য সংখ্যক রেস্টুরেন্ট এসব করে এবং তারাও হয়তো খুব অল্প মাত্রায় এটি করে। কিন্তু একবার বিশ্বাস ভঙ্গ হলে সেটি জোড়া লাগানো কঠিন।
অনেক সময় রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বও এসব গুজব বা অভিযোগ ছড়ানোর পেছনে কাজ করে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেই যেমন চট করে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি বাছবিচার না করে বিশ্বাস করাও বিপদ। বিপদ ব্যবসার, অর্থনীতির। এ ধরনের অভিযোগ রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধস নামাতে পারে। করোনা মহামারিকালে অর্থনীতির যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রেস্টুরেন্ট তার অন্যতম। সেই ব্যবসাটি এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সুতরাং এমন কোনো অভিযোগ বা গুজব ছড়ানো ঠিক নয়, যা এই ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে। কিন্তু সেইসঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও সতর্ক থাকা দরকার, যাতে মানুষ কোনোভাবেই এই ধরনের গুজব বা অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ না পায়।
রাস্তায় কুকুর নেই কেন, বাজারের মরা মুরগিগুলো কোথায় যায়—এসব প্রশ্নের সদুত্তর থাকতে হবে। মানুষের মনে যে আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সেটি দূর করা রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব, তেমনি ব্যবসায়ীদেরও।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতি মুনাফা করা, দ্রুত ধনি হওয়া, ভোক্তাদের ঠকানোর প্রবণতাও অনেক বেশি। রমজানের মতো একটি পবিত্র ও সংযমের মাসে পৃথিবীর নানা দেশে যেখানে নিত্যপণ্যের দাম কমে, ব্যবসায়ীরা মূল্য ছাড় দেন, বাংলাদেশে হয় তার উল্টো। স্বাভাবিক সময়ে ১০০ টাকার জিনিস এখানে রোজার মাসে ১৫০-২০০ টাকা হবে, এটি এখন স্বতঃসিদ্ধ। ফলে সেই দেশের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ যে ১ মণ গরু ও খাসির মাংসের ভেতরে ১০ কেজি কুকুরের মাংস ঢুকিয়ে দেন না, সেটি চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া কঠিন। তবে প্রমাণ পাওয়ার আগে কারো বিরুদ্ধে ঢালাও মন্তব্য করা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল করা অথবা অভিযোগ পাওয়ামাত্রই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেওয়াটাও যৌক্তিক নয়। সবখানেই সংযত ও সহনশীল আচরণ করা দরকার।
কোনো বিষয়ে চট করে উপসংহারে পৌঁছানোর যে বাতিক বা যে প্রবণতা সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তৈরি হয়েছে, সেটি এখন একটি বিরাট সমস্যা। মানুষ এত বেশি জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে যে, ফেসবুকে কারো কোনো একটি স্ট্যাটাস বা কমেন্ট পড়েই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করে ফেলে। তাকে কোনো একটি দল বা গোষ্ঠীর দালাল বলে গালি দেয়। অথচ হতে পারে তিনি এর আগে পরে ওই একই বিষয়ে ভিন্ন কিছু বলেছেন, লিখেছেন। কিন্তু এখন মানুষ কাউকে বিচার করার ক্ষেত্রে আর সময় নিতে চায় না। কাচ্চিতে কুকুর-বিড়ালের মাংসের ক্ষেত্রেও সম্ভবত কোনো বিষয়ে মানুষের দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার এই প্রবণতাটিই কাজ করেছে।
এক্ষেত্রে সরকারের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বশীল অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারি বাড়াতে হবে। মানুষের মনে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করার ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও অতি মুনাফার চিন্তা বাদ দিয়ে আগে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় রাখতে হবে। পয়সার জন্য মানহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ খাবার খাইয়ে ভোক্তার শরীরে অসুখের বীজ বুনে দেওয়ার অধিকার কারো নেই।
সারা পৃথিবীতেই খাবারের ব্যবসাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে যেমন দেখা হয়, তেমনি এটিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও মনে করা হয়। কারণ সামান্য অসাবধানতায় খাবারে বিষক্রিয়া হতে পারে, যা মুহূর্তের মধ্যে কারো প্রাণ সংহারের কারণ হতে পারে। অতএব ব্যবসা ও মুনাফা নয়, বরং মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যই যে মূল কথা, ব্যবসায়ীরা যদি সেটি মনে রাখেন এবং মেনে চলেন, তাহলে কাচ্চিতে কুকুরের মাংস আছে বলে গুজব ছড়ালেও ভোক্তারা সেটি বিশ্বাস করবে না।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments