ষাঁড় দোষে স্যার বিনাশ

'স্যার' শব্দ শুনতে উতলা হয়ে থাকা তথাকথিত শিক্ষিত, প্রকারান্তরে অশিক্ষিত উজবুকগুলো মাঝেমধ্যেই জানান দিচ্ছেন তাদের প্রকৃত জাত ও রুচির পরিচয়। কিন্তু, নানা ঘটনার ঘনঘটায় তা আলোচনা থেকে হারিয়ে যায়। আড়াল হয়ে যায় প্রেক্ষাপট।

'স্যার' বাতিকে সম্প্রতি টোকা দিয়েছেন রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন। তাও আবার এক স্যারেরই সঙ্গে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমর ফারুক স্যার (সহযোগী অধ্যাপক) কেন ডিসি নাজনীনকে 'স্যার' বলে সম্বোধন করলেন না- এ সংক্রান্ত ঘটনাও সম্ভবত বেশি দূর গড়াবে না। ডিসি, এসপি, ইউএনও ধরনের কেউ কোথাও নিজেকে জনগণের চাকর-সেবক ধরনের একটা বক্তব্য দিয়ে কিস্তি ঘুরিয়ে দেবেন। অথবা কোনো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে কদমবুচি দিয়ে বলবেন, 'আমি মোটেই স্যার নই, প্রকৃত স্যার হলেন আপনি'। এ ধরনের সংবাদ ভাইরাল হতে বেশি সময় লাগে না।

স্যারের আক্ষরিক অর্থ- জনাব, মহোদয়, হুজুর, হযরত ইত্যাদি। আর প্রায়োগিকভাবে 'সম্মানিত' কেউ। শিক্ষকদের স্যার সম্বোধন করার বিশেষ চর্চা বহুদিনের। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শুরু থেকে বঙ্গীয় সমাজে স্যার ডাকা সম্মানসূচক। হালে একশ্রেণির কাছে 'স্যার' ডাকটি আদায় করে ছাড়ার বিষয়। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি উম্মুখ হয়েই থাকেন 'স্যার' ডাক শুনতে। মোবাইল, ব্যাংক বা বিমানের টিকেটিং কোম্পানিতে আবার ব্যতিক্রম। সেখানে নিচু পর্যায়ের কাস্টমারকেও 'স্যার' সম্বোধনের সংস্কৃতি চলে। সেখানেও আবার সীমাহীন সাংঘর্ষিক চিত্র। কাস্টমারদের দিক থেকে কাউন্টারের ওপাশের জনকে নাম ধরে ডাকা দুরে থাক, করজোরে দাঁড়াতে হয়। কে সেবাদাতা, কে গ্রহীতা বোঝার অবস্থা থাকে না। বছর কয়েক ধরে টিভি-রেডিওতে বিচারকের আসনে বসা শিল্পীকেও গুরুজি-ওস্তাদজির বদলে 'স্যার' সম্বোধনের রীতি চালু হয়েছে।

আমাদের এ বঙ্গে 'স্যার' চালু করা ব্রিটিশ রাজ্যের দেশেও এখন স্যার সম্বোধনের চল উঠে সরাসরি নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। নামের আগে ডক্টর-ডাক্তার, প্রফেসর, মিস্টার যুক্ত করা হয় সম্মানের সঙ্গে। কথায় ব্রিটিশদের গাল দিয়ে এক ধরনের তুষ্টিতে ভুগলেও আমাদের তথাকথিত বরেণ্য তথা ক্ষমতাধররা ব্রিটিশদের চালু করা 'স্যার'-এর ভুত ধরে রাখতে বড্ড আগ্রহী। কিন্তু, ব্রিটিশদের 'স্যার' পরিহারের শিক্ষা নিতে আগ্রহী নন। তারা কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য কায়েম করতে 'স্যার' ছাড়তে নারাজ। এর মধ্য দিয়ে রীতিমতো ষাঁড়ে পরিণত হওয়া এই শ্রেণির কাউকে থাপ্পড়-চড় মেরেও 'স্যার' ডাক আদায়ের ঘটনা এর আগেও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। বাদবাকি সবাইকে তারা অধীনস্ত, এমন কি চাকর ভাবতেও অভ্যস্ত। এখানে ব্যক্তি বিশেষ বিষয় নয়। বিষয়টি সামন্তবাদী চর্চার। এ ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে কেবল 'স্যার' কেন তাদের 'জাঁহাপনা' সম্বোধন আদায় করে নিতেও বাধা পড়বে না। তারা উপলব্ধিই করতে পারেন না, সামনাসামনি 'স্যার' ডেকে মাথা চুলকালেও পেছনে গেলেই গালমন্দ জোটে তাদের ভাগ্যে। এসবের মধ্য দিয়ে বলার বাকি থাকছে না যে, আমাদের দেশটিতে বীর বাঙালি ছিল, পদলেহী বাঙালির সংখ্যাও বাড়ছে। তা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা প্রকৃত 'স্যার' হারিয়ে ফেলছি না তো? শিক্ষকদের এখন স্যার না ডাকলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু, তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষক হয়ে 'স্যার' হওয়ার চেয়ে শাসক হয়ে 'স্যার' হবার লিপ্সা ভর করছে মারাত্মক পর্যায়ে। কর্মজীবনে প্রশাসক হয়ে 'স্যার' হতে যারপরনাই উদগ্রীব তারা। এই মেধাবীদের মধ্যে শিক্ষক-গবেষক হওয়ার চেয়ে শাসক-প্রশাসক হয়ে 'স্যার' হওয়ার দৌড়।

এর তেলেসমাতিটা বড় তেলতেলে। শাসক-প্রশাসক হওয়ার পরও নিজেদের প্রজাতন্ত্রের চাকর সাজিয়ে মনিব হয়ে যাওয়ার চাতুরিটা বড় চমৎকার। বিদ্বান-গবেষক হওয়ার উপযুক্ত মেধাবানরাও তা বুঝে শাসক-প্রশাসক হয়ে ইহকালীন মওকা মেলার গণিত বুঝে ফেলেছেন। কেবল জনগণ নয়, তারা জায়গা মতো রাজনীতিকদের ওপর ভর করছেন। আয়ত্ব করছেন সরকারকে বশীকরণের পাশাপাশি জনগণকে চিড়েচ্যাপ্টা করে নিজেদের সুখ-সম্ভোগের সামর্থ্য।

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে চমৎকার রেজাল্ট করে মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং বা এগ্রিকালচারে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শাসক হওয়ার মোহে তারা কি হারে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকছেন গত কয়েক বছরের হিসাবে চোখ বুলালে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং-মেডিকেল-কৃষি বা সায়েন্সের ভালো ভালো সাবজেক্টে পড়ে কেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যাওয়ার মোহ তৈরি হয়েছে তা গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয়। সমস্যাটি 'স্যার' এর নয়, 'স্যার' নামের সম্প্রদায়ের। যে কারণে প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ, কাস্টমস এবং ফরেন সার্ভিস ক্যাডারেও অভিষেক ঘটছে অনেকের। এই মেধাবীদের প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, গবেষক বানানোর কত আহ্লাদ ছিল অভিভাবকদের। খোয়াড়ের ডিম, মুরগি থেকে গোয়ালের ছাগল-গরু, এমন কি জমিজিরাতও বেচতে হয়েছে কোনো কোনো অভিভাবকের। টাকার অংকে তাদের একেকজনের জন্য সরকারের খরচ হয়েছে আরও বেশি। কোটি-কোটি টাকা। সরকারের দেয়া টাকাটা কিন্তু আদায় করা হয়েছে জনসাধারণের পকেট থেকেই। গবেষক-সাধক-উদ্ভাবক হওয়ার মতো উপযুক্ত দেশসেরা এই বিশেষায়িত মেধাবীদের সাধারণ ক্যাডারে ঢুকে অসাধারণ হওয়ার মোহ কি এমনি-এমনিই জেগেছে?

দেশে বা সরকারে গবেষকের আবশ্যকতা- মর্যাদা না থাকার মতো। ডিসি থেকে ভিসি-ইসি কোথাও গবেষকের কদর নেই। চাহিদাও নেই। চারদিকে কেবল প্রশাসকের রাজত্ব। দেশে গবেষণার নীতিমালা সম্পর্কেও ধোঁয়াশা। 'গবেষক' নামে কোনো ক্যাডারও নেই। তবে, কিছু কিছু দপ্তরে গবেষণা সেল আছে। সেখানে কে গবেষক, তিনি কার অধীনে, কী দশায় আছেন তা মর্মে-মর্মে বোঝেন কেবল অসাধারণ কৃতি মেধাবী শিক্ষার্থীই। তারা চোখের সামনে দেখছেন কেবল প্রশাসক হওয়ার দাপটে গাড়ি হাঁকাচ্ছেন কিছু লোক। আদাব-সালাম নিতে নিতে কাহিল এই 'স্যারেরা'। তাদের চোখ ধাঁধানো শান শওকত, বাড়ির আকার আয়তন, সরোবর, প্রটোকল রাষ্ট্রে-সমাজেও সংবর্ধিত।

সংস্থাপনের নাম 'জনপ্রশাসন' মন্ত্রণালয় হওয়ার পরে তারা 'অফিসিয়ালি'ই জনগণের শাসক- প্রশাসক অধিকর্তা। নামের সঙ্গে শাসক, প্রশাসক, কর্মকর্তা, নির্বাহী ধরনের শব্দ থাকার পরও 'জনসেবক, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নামাবলী নিতান্তই একটা চাতুরি। এই ক্যাটাগরির ব্যক্তিদের কেউ 'স্যার' না ডাকলে স্যাররা তো গোস্বা হবেনই। আর তারা গোস্বা হলে কী পরিনতি হয় তা ভালো জানেন ভুক্তভোগীরা। এ ভুক্তভোগীর তালিকায় মাঝেমধ্যে মাননীয়রাও পড়ছেন। মহান জাতীয় সংসদে ক'দিন আগেও কয়েক মাননীয় বলেছেন জগতশেঠদের কাছে পাওয়া সেই বেদনার কথা। বলেছেন, রাজনীতিবিদের এখন আর গুরুত্ব নেই। তাদেরকে সাইডলাইনে ফেলে আমলারাই এখন সব। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যত দাপট স্যারদেরই। এত কঠিন কথার পর পারস্পরিক স্বার্থগত কারণে মাননীয়-মহাশয়রা তা আবার চেপেও গেছেন। বেগতিক অবস্থায় পড়ে গেলে এ স্যারদের নিন্দাবাদ করা রাজনীতিকদের কারো কারো কাছে ফ্যাশনের মতো। আবার প্রসঙ্গ ছাড়াও তারা আমলাদের দোষেন। তুলাধুনা করেন। গণমাধ্যম তা গুরুত্বপূর্ণ ভেবে লুফে নেয়। পরে অল্পতেই স্যারে আর ষাঁড়ে মিলিয়ে যায় সব ক্ষোভ-বেদনা ও নিউজ ভ্যালু। এবারের লক্ষণও প্রায় তেমনই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

How frequent policy shifts deter firms from going public

If a company gets listed, it will enjoy tax benefits, and this is one of the major incentives for them to go public..However, the government’s frequent policy changes have disheartened listed firms many times, as they faced higher tax rates once they got listed..It gave a clear, nega

34m ago