শামীম শিকদার সাহস ও শিল্পের প্রতীক

কত জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন!
শামীম সিকদার
শামীম সিকদার। ছবি: সংগৃহীত

ভাস্কর শামীম শিকদারকে প্রথম দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসু ভবনে। তখনো নামে মানুষ চিনতাম না। দেখলাম গড়পড়তা বাঙালি নারীদের থেকে দেখতে একটু ভিন্ন অবয়বের মধ্যবয়স পেরোনো এক নারী চারপাশে সবকিছুকে তুচ্ছ করে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। পরনে গোল গলার গেঞ্জি, জিন্স। বলিষ্ঠ তার চেহারা। কৌতূহলে ডাকসুর সংগ্রাহক গোপাল দা'কে জিজ্ঞেস করলাম কে এই নারী। গোপাল দা তার সঙ্গে একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে আমার মতো অর্বাচীণ এক তরুণের কি-ই বা আলাপ থাকতে পারে। এখন মনে হয় ইতিহাসের গলি-ঘুপচি জানার জন্য একটু চেষ্টা তদবির করা যেত। কত জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন!

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাস হতো তখন কলাভবনে। কলাভবনে ক্লাসের ফাঁকে নিয়মিত ডাকসুর দোতলায় পত্রিকা পড়তে ঢুঁ মারি। পত্রিকা পড়ে নামার ফাঁকে নিচে সংগ্রহশালায় গোপাল দা'র সঙ্গে তার টেবিলে বসে প্রায়ই নানা প্রসঙ্গে আলাপ হয়। ক্যাম্পাসের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী গোপাল দা। সেসব স্মৃতিচারণ করেই 'মণিদীপ্ত ক্যাম্পাস' বইটি লিখছেন। মাঝেমধ্যে সে বইয়ের খসড়া পড়ে শোনান। ছোট ছোট সুন্দর হস্তাক্ষরের কালো রঙয়ের ডায়েরিটা কখনো আমাকেও পড়তে দিয়ে মতামত শুনতে চান। সেখানেই বেশ কদিন শামীম শিকদারকে বসে থাকতে দেখেছি নির্লিপ্তভঙ্গিতে এবং যথারীতি ধূমপান করতে। গ্রাম বা মফস্‌সল থেকে আসা আমাদের মতো তরুণদের চোখ এমন দৃশ্য দেখে অনভ্যস্ত। তাই এই আলাদা মন ও মেজাজের নারীকে দেখে কিছুটা চমকে উঠতাম। ঠিক রমণীয় কণ্ঠ নয়, পুরুষালি একটা ভাব আছে। লেখক আহমদ ছফার "অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী" পড়লে তাকে দুরদানা নামে দুর্দান্তরূপে পাওয়া যায়। ছফার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা ছিল। সত্তরের দশকে ঢাকায় এই তরুণী সাইকেল চালিয়ে শহরময় ঘুরতেন যখন অনেক নারীই ঘরের বাইরে একা যেতেন না। শোনা যায় ঢাকার রাস্তায় কোনো এক দুর্বৃত্ত তার পরনের ওড়না টান দিয়েছিল বলে প্রতিবাদে আর কোনোদিন ওড়না পরেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন ভাস্কর্য নির্মাণ করছিলেন তখন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এলাকাটি ঘেরাও করে ভাস্কর্য ভেঙে দেবে বাতাসে এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। শামীম শিকদার তার হাতের শাবল ও ছেনি নিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন এদের মোকাবিলা করার জন্য শামীম একাই যথেষ্ট। বেপরোয়া এই নারীর ভয়ে কেউ নাকি আর ওমুখো হয়নি। পকেটে মাঝেমধ্যে পিস্তল নিয়েও ঘুরতেন। তার সহোদর ছিলেন বিপ্লবী সিরাজ শিকদার। পারিবারিক সূত্রেই হয়তো এমন সাহস নিয়ে রক্ষণশীল এক সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন আমৃত্যু।

'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা' ছাড়াও জগন্নাথ হল সংলগ্ন 'স্বাধীনতা সংগ্রাম'-এ কীর্তিমান বাঙালিদের আবক্ষ মূর্তি ক্যাম্পাসে তার অন্যতম কাজ। জগন্নাথ হলে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য, চারুকলায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যও তার কীর্তি। তিনি অধ্যাপনা করেছেন, একুশে পদক পেয়েছেন। এমন রাষ্ট্রীয় সম্মান আরও অনেকে পেয়েছেন, পাবেন কিন্তু একজন নারী হিসেবে তার সাহস ও সংগ্রামকে ঘিরে অনেক কিংবদন্তি আছে যা সবাই জন্ম দিতে পারে না। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে চরম রক্ষণশীল সমাজে শিল্পের জন্য তার একটি ডেসপারেট জার্নি ছিল। শুধু এজন্যই তিনি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গুণী এ মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন শুনে দূর দেশ থেকে মনটা বেদনার্ত হয়ে আছে। পোড়া দেশে পশ্চাৎপদ সমাজে তিনি বেঁচে থাকুন সাহস ও শিল্পের প্রতীক হয়ে।

আলমগীর শাহরিয়ার:কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

44m ago