বঙ্গবাজার: জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সিন্ডিকেট

গত মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

সেদিনের সেই কিশোর ছেলে জসীম ব্যবসা করতে করতে এখন ৪টি দোকানের মালিক। টেলিফোন ইন্ডেক্সে 'বঙ্গ জসীম' নামে তার নাম লেখা আছে। সারাদিনে ভয়ে ওকে ফোন দেইনি। সন্ধ্যায় ফোন করে জানলাম ঈদ উপলক্ষে প্রায় ২ থেকে আড়াই কোটি টাকার কাপড় তুলেছিল ৪টি দোকানে। এখন সব শেষ। একটা সুতাও বাঁচাতে পারেনি। তার সঙ্গে জড়িত সবাই পথে বসে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো, 'শুধু দোয়া করেন আমাগো জন্য। আর কানতেও পারতাছি না।'

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবাজারে নিয়মিত কেনাকাটা করি আমরা। জসীমকে দেখেছি সেখানে একটা দোকান নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে। ক্রমে তিনি আমার ভাইয়ের মতো হয়ে গেছেন। তার মারফতে ওই মার্কেট থেকে গরম কাপড়, ছেলে মেয়েদের গেঞ্জি, শার্ট, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, প্যান্ট, ব্যাগ, জুতা সবকিছু কিনি। কারণ এটা হোলসেল মার্কেট, দাম কম এবং মান ভালো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার ছবি দেখে মনটা হু হু করে উঠলো। বারবার চোখের সামনে সেখানকার দোকানগুলো, দোকানি ও সুন্দর কাপড়গুলোর কথা ভেসে উঠলো। আহা তাদের কী অবস্থা এখন। সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসলো অসংখ্য মানুষ ও পরিবার।

এই অসহায় মানুষগুলো নিজেদের টাকা খাটিয়ে, ঋণ করে, শ্রম দিয়ে ব্যবসা করে। অন্যদিকে তাদের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। তারা যখন ধ্বসে পড়ে, যখন এদের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তখন কিন্তু ওই সিন্ডিকেট, যারা পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে মিষ্টির ভাগটা খাচ্ছিল, তারা গা ঢাকা দেয়। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি পুড়ে গেলেও, তাদের শরীরের একটি লোমও পোড়ে না।

বঙ্গবাজার নিয়ে সারাদিন নানান উৎকণ্ঠা ও কথাবার্তার পর সন্ধ্যায় তুখোড় সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু তার স্ট্যাটাসে লিখলেন, দক্ষিণ সিটি মেয়র তাপস বলেছেন 'বঙ্গবাজার মার্কেট ২০১৯ সালে সিটি কর্পোরেশন "ঝুঁকিপূর্ণ" ঘোষণা করে। তখন নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেইসময় মার্কেট সমিতি নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন।'

অবশ্য মেয়র তাপস যেটা বলেননি তা হলো, 'যিনি এই মার্কেট ও আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি ১২ বছর ধরে গুম বা নিখোঁজ। এরপর এক এমপি নিয়ন্ত্রণ নিলেন। আগের নিয়ন্ত্রকের সব সাঙ্গ পাঙ্গ নতুন নিয়ন্ত্রকের সাথী হলেন। মজার ব্যাপার হলো এই সিন্ডিকেট জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং খেলাফত নেতাও আছেন। বহুতল ভবন হলে তো তারা তোলা পাবেন না।'

বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বিষয়ক সম্পাদক সুমন জাহিদ একই কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, '২০১৮ সালে বঙ্গবাজারকে বহুতল আধুনিক মার্কেটে পরিণত করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে কার্যাদেশও দেওয়া হয়। বহুতল ভবন নির্মাণের সাইনবোর্ডও লাগানো হয় বেশ কয়েকবার। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের কারণে সিটি করপোরেশন গত ৫ বছরেও কাজ শুরু করতে পারেনি।'

এত অপ্রিয় সত্য কথা আর হয় না। এতগুলো মানুষ কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়ে পথে বসলেন কিন্তু সিন্ডিকেটের সদস্যরা কিছুই হারালো না। উদভ্রান্ত ও ক্ষিপ্ত ব্যবসায়ীরা রাগ হয়ে ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যদের গালাগালি করেছেন, ফায়ার ব্রিগেডের হেড অফিসে হামলা চালানোরও চেষ্টা করেছেন। এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর মহাপরিচালক বলেছেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের ২রা এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটের ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন ভবনে একটি ব্যানারও টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপরেও ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই ব্যবসা চলছিল।

২০১৯ সালে যখন সাংবাদিকরা অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়েছিল, তখন দোকানিদের কেউ কেউ তাদের আটকে রেখে মারধোর করেছিল। তারা সেদিন বলেছিল 'আমাদের নিরাপত্তা লাগবে না'। সাধারণ ব্যবসায়ীরা ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেননি তাদের নিরাপত্তা কতটা দরকার? চিনতে পারেননি কারা তাদের পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। আজকে তারা সব খুইয়েও রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারলেন কিনা কে জানে।

শুধু কি বঙ্গবাজার বা গুলিস্তান বা নিমতলী বা নাজিরাবাজার? ঢাকার অভিজাত বনানী-গুলশান এলাকাও আগুনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ঢাকায় বার বার ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এসব ঘটনায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা, ক্ষতির পরিমাণ। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় আগুনে দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি।

কেন এত দুর্ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে সেটা বোঝার জন্য খুব বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই নগরীতে লোকসংখ্যা ধারণক্ষমতার চাইতে দ্বিগুণ বা তার চাইতেও বেশি। এখানে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যাজেট, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জারসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থ অনেক বেশি হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আমরা যেভাবে বাসা বাড়ি, দোকানপাট বানিয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে বহুতল ভবন, উচ্চবিত্তের এলাকা, গলি-ঘুপচি, বস্তি, নতুন ঢাকা-পুরান ঢাকা কোনটাই নিরাপদ নয় অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে। অগ্নিকাণ্ডের বেশি ঘটনা ঘটেছে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট থেকে। এর পরই বেশি আগুন লেগেছে চুলা থেকে। পেট্রোল পাম্প, গ্যাস পাইপের লিকেজ, বিভিন্ন গুদাম ও ভাঙ্গারির দোকানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকা এমনই একটি অবসবাসযোগ্য শহর যেখানে হাসপাতালেও আগুন লাগে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানুষকে মূক করে দিয়েছিল। হাসপাতালের স্টোর রুমে আগুন লাগার খবরে রোগী, স্বজন, চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী আগুন ও ধোঁয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে হাসপাতাল থেকে নেমে এসেছিলেন।

চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জন নিহত হন। সেই আগুন রাসায়নিক ও প্ল্যাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের জন্য বেশি ছড়িয়েছিল বলে ফায়ার সার্ভিস বলেছিল। ২০০৯ সালে বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগে। ২০১০ সালে নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত হন ১২৪ জন, ২০১২ তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১১ জন নিহত হন। ২০১৭ সালে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুন, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে হাজারীবাগের বউবাজার বস্তিতে আগুন, ২০১৮ সালে পল্লবীর ইলিয়াস আলী মোল্লা বস্তিতে আগুন লেগে সব ঘর পুড়ে যায়।

২০১৭ সালে গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটটির বহু দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরপর ২০১৯ সালে আবার একই ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়।

২০১২ সালে গরীব অ্যান্ড গরীব গার্মেন্টসে এবং হামীম গ্রুপের অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকজন নিহত হন। ২০১৩ সালে মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টস লিমিটেডে আগুনে পুড়ে ৭ নারী পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এইসব ঘটনা শুধু ঢাকা শহরের এবং গত ১০ বছরের।

২০২১ সালে সারা দেশে ২২ হাজার ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মোট ৩৩০ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে ২ হাজার ৫৮০ জন নিহত হয়েছেন। (ইত্তেফাক, ২০২২)। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা-বরগুনা লঞ্চেও ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কোনো শেষ নাই। একটার পর একটা ঘটেই যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমাদের আধুনিক নগরায়ন যত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তত দ্রুততার সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাড়ছে না। দিনের পর দিন সুউচ্চ ভবনগুলো গড়ে উঠছে ইমারত নির্মাণবিধিকে উপেক্ষা করে। এ বিষয়গুলো মনিটরিং করা হচ্ছে না। আবার যারা ইমারত নির্মাণ করছেন তারা কিছু টাকা আর জায়গা বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই আগুনজনিত দুর্ঘটনায় নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করেন।'

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকে বলেছে, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষ, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, খোলা বাতির ব্যবহার, চুলার আগুন, মিস ফায়ার, চিমনি, রাসায়নিক বিক্রিয়া, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি কারণে আগুন লাগে। শহরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ (এসি, ফ্রিজ),গ্যাসের চুলাসহ আবাসিক এলাকায় দাহ্যপদার্থ রাখা, কারখানা স্থাপনের কথা উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সেও সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ। (ইত্তেফাক)

আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য যে পানি দরকার, সেই পানির উৎস কোথায় আমাদের? বহুবার পানির এই উৎস নিয়ে কথা হয়েছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বঙ্গবাজারে হেলিকপ্টার দিয়ে হাতিরঝিল থেকে পানি এনে ঢালতে হয়েছে। এই নগরে এমনও রাস্তা রয়েছে যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স কিছুই যেতে পারে না।

আমরা কি এখন এই অনুরোধ করবো, আরও লেক, খাল, পুকুর, ও নদী ভরাট করে এবং এমনভাবে জলাশয়গুলো ঢেকে দেন যাতে প্রয়োজনে আমরা কেউ একফোঁটা পানিও না পাই?

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগকর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

  

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

4h ago