হাত বাড়ালেই মাদক পাবে, যতো খুশি তত পাবে

মাদক চোরাচালানে প্রতি বছর দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সরকারি কার্যালয়ে বসে মাদক গ্রহণের অভিযোগে যখন উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়, তখন বুঝতে হবে যে মাদকের ডালপালা তৃণমূলেও বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। যদিও হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, 'আমি মাদক নেইনি। শারীরিক সমস্যার জন্য আমি হারবাল ওষুধ নিয়েছিলাম। এটাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।'

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ভাইস চেয়ারম্যান নিজের সরকারি কার্যালয়ে মাদক মামলার এক আসামির হাত থেকে ফেন্সিডিলের বোতল নিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।

চারদিকে এত ধরনের মাদক পাওয়া যায় যে কে, কখন, কী গ্রহণ করছেন, সেটা ঠাওর করাই কঠিন হয়ে যায়। সাধারণভাবে বলা হয়, ২৪ ধরনের মাদক আছে বাংলাদেশে। তবে বাংলাদেশের মাদকসেবীরা সেবন করে ৬ থেকে ১০ ধরনের মাদক।

বেশ কয়েক বছর আগে সকাল ৮টার দিকে আসাদ এভিনিউ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ৫-৬টি কিশোর তাদের স্কুল ড্রেস পরেই মোহাম্মদপুর টাউনহলের পেছনে চলে গেল। প্রশ্ন জাগলো, ছেলেগুলো এই সময়ে স্কুলে না গিয়ে ড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? আমার সঙ্গী এক কিশোর জানালো, বিভিন্ন স্কুলে ছেলেদের নাকি এরকম গ্রুপ থাকে, যারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাদক গ্রহণ করে। অভিভাবকরা তাদের স্কুলের কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়। এরপর তারা কোনো এক কায়দায় স্কুলে না ঢুকে এদিক-ওদিক চলে যায়।

সেদিন ব্যাপারটা নিয়ে বিচলিত বোধ করেছিলাম। একটা শঙ্কা কাজ করেছিল বাচ্চাগুলোর জন্য, মায়া লেগেছিল তাদের মা-বাবার জন্য। মা-বাবা এবং এই সন্তানরা কেউই হয়তো জানে না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

সম্প্রতি দুটি খবর দেখে মনে পড়ে গেল সেই স্কুল পালানো ছেলেদের কথা। খবর দুটি হচ্ছে, মাদকসেবনের জেরে দুই পক্ষের কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে দুই কিশোর গ্রুপের মধ্যে ছুরি নিয়ে মারামারি হয়েছে। অন্যদিকে কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক তার বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হন ভাতিজার হাতে। ভাতিজা নওরোজ মাদক ও অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে এবং ফুপুর শাসনের জেরে শিল দিয়ে মাথায় আঘাত করে রোকসানাকে হত্যা করে।

শুধু নওরোজ একা নয়, 'গ্যাং কালচার' বলে কিশোর-তরুণদের কিছু ভয়াবহ অপরাধী গ্রুপের উত্থান ঘটেছে। তারা অপরাধী, কিন্তু বয়স কম। অবশ্য বয়স কম বলে যে বীভৎস কায়দায় অপরাধ ঘটাতে পারছে না, তা নয়। কিশোর গ্যাং এলাকায় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। তারা এলাকার দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত, বন্ধুকে মেরে ফেলা, মারার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া—সবই করছে। তাদের এই আচরণের পেছনে যত ধরনের কারণ রয়েছে, দার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মাদক গ্রহণ।

বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্টতার হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধিটা কিন্তু খুব সাম্প্রতিককালের নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, শতকরা ৪৪ ভাগ পথশিশু মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শিশু মাদকাসক্ত এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ শিশু মাদক গ্রহণের খরচ মেটাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

মাদকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত—সবখানেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। গোপনে বিক্রি হলেও কিশোর-তরুণ এবং বয়স্ক মানুষ সবাই জানে কার কাছে, কীভাবে ইয়াবাসহ অন্য মাদক পাওয়া যাবে। মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে বলেছেন, আসলে ইয়াবার জন্য মিয়ানমারের পছন্দের বাজার ছিল থাইল্যান্ড। কিন্তু আমাদের দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কল্পনার বাইরে চলে যাওয়ায় ইয়াবার বড় বাজারে পরিণত হয় বাংলাদেশ। এই তথ্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও ভীতিকর। বলা হয়, দেশে যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়, তা মোট চোরাকারবারের ১০ ভাগেরও কম।

'কুশ' নামে ভয়াবহ একটি মাদক এখন বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও সম্প্রতি বেশি উদ্বেগের কারণ ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। তবে মাদক হিসেবে 'কুশ বেশি ভয়ংকর ও ক্ষতিকর' বলে মনে করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, এটি একটি সিনথেটিক মারিজুয়ানা, যা বাংলাদেশের প্রচলিত গাঁজা থেকে অন্তত ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। হিন্দুকুশ পর্বতমালা যেমন বৈরী, বিপদসংকুল ও ভয়ংকর, তেমনি সেখানে উৎপাদিত গাঁজা থেকে তৈরি এই কুশ মাদকটিও সেরকমই ভয়ংকর। বিশেষ করে ঢাকার অভিজাত এলাকার পার্টিগুলোতে এগুলো সরবরাহ করা হতো এবং সেই সূত্র ধরেই এগিয়েছে র‌্যাব।

মাদক চোরাকারবারের রাঘববোয়ালরা কেউ ধরা পড়ে না। অনেকে বিদেশে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মাদক চোরাকারবার। দু-চারটা চুনোপুঁটি গ্রেপ্তার করে লাভ হয় না কিছুই। তাছাড়া, মাদক চোরাকারবারিদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও মাদকসেবীদের গ্রেপ্তারে তারা আগ্রহী হয় না। কারণ মাদকসেবীদের কারাগারে আটকে রাখলে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।

মাদক চোরাচালানে প্রতি বছর দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী মাদক গ্রহণকারীর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সামাজিক স্টিগমার কারণে নারী মাদকসেবীরা চিকিৎসা গ্রহণে অনাগ্রহী। নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই মায়েদের সন্তান হবে সবচেয়ে বিপদাপন্ন।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৪৭ জন নারীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১২৯ জন রোগী পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। চিকিৎসা গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ ইয়াবা, ২৮ শতাংশ গাঁজা, ১৬ শতাংশ ঘুমের ওষুধ, ১৫ শতাংশ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের মাদক, ২ শতাংশ মদ, ২ শতাংশ শিরায় মাদক গ্রহণকারী।

সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, এই রোগীদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া ৩৪ শতাংশ, মুড ডিজঅর্ডার ৩০ শতাংশ, বাইপোলার ১২ শতাংশ, ডিপ্রেশন ১০ শতাংশ, ওসিডি ৬ শতাংশ ও বাকিরা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

কেন মাদক গ্রহণের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে? এর মধ্যে রয়েছে কৌতূহল, বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষণ্ণতা, হতাশা, অতিরিক্ত রাগ-জেদ, সমাজের প্রতি বিরক্তি, নিজের প্রতি বা অন্যের প্রতি ঘৃণা। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেওয়ার প্রবণতা এবং সর্বোপরি হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাদক। যতো চাও ততো পাবে, যে মাদক চাও তাই পাবে।

পারিবারিক ও সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে নারী মাদকসেবীদের বিষয়টি আমাদের দেশে প্রায়ই প্রকাশ্যে আসে না। ফলে এ সমস্যার সমাধান সহজ হয় না। মাদকের হাত থেকে শিশু-কিশোরদের রক্ষা করার দায়িত্ব পরিবারের। অথচ পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ততা ও অসচেতনতার কারণে শিশু-কিশোররা বিপথে যাচ্ছে। এই সময় দিতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে অভিভাবকরা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য ও ব্যাপক স্বাধীনতা। এই প্রশ্রয় সন্তানকে করে তোলে বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও অপরাধী।

মাদকবিষয়ক গবেষক ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ইমদাদুল হক মনে করেন, 'মাদক চোরাকারবারে বহুমাত্রিকতা এসেছে। চোরাকারবারিরা এখন "ডার্কওয়েব" ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতে কোনো ধরনের তথ্য পাচ্ছে না। লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বিটকয়েন। এ কারণে মাদক চক্রকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মাদক চোরাকারবারিরা যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করছেন, সে অনুযায়ী আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নেই। সক্ষমতা অর্জনে উদ্যোগ না নিলে দেশে আরও বেশি মাদকের ঝুঁকি তৈরি হবে।'

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের হিসাবে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ এবং সবচেয়ে বেশি মাদক ব্যবহারকারী আছে ঢাকা বিভাগে। যদিও বেসরকারি হিসাবে, মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ লাখের কাছাকাছি বলে দাবি করে বিভিন্ন সংস্থা।

ডিএনসির এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ১০ লাখ মানুষ মাদক চোরাকারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে মাদক পাচারে এক লাখ নারী ও শিশুকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যেসব নারী ও শিশুকে মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আর মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪ ভাগের ১ ভাগই তরুণ। তাদের অধিকাংশ আবার শিক্ষার্থী। মাদকে তরুণ-তরুণীরাই বেশি ঝুঁকছেন। আমাদের দুশ্চিন্তা এই তরুণদের নিয়ে। যাদের ওপর নির্ভর করে পরিবার, দেশ ও দেশের মানুষ এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তারাই যদি মাদকাসক্ত হয়ে মৃৎবত পড়ে থাকে, তাহলে পরিবার, দেশ, জাতি কাদের অবলম্বন করবে?

যেহেতু মাদকনির্ভরশীলতা একটি অসুস্থতা, তাই মাদকাসক্তি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা ব্যক্তিরাও পুনরায় মাদক গ্রহণ করতে পারেন। এ জন্য পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে। সেক্ষেত্রে সমাজের সবপর্যায় থেকে সচেতনতা তৈরির কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের শিশু, কিশোর ও তরুণদের মাদকের হাত থেকে বাঁচাতে হলে পরিবারকে সচেতন হতে হবে। সরকারকে কঠোর হাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এই অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, প্রতিবেশী দেশে মাদকের ভয়াবহতা থাকলে, এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বেই।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগ কর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

14h ago