বিচারহীনতা: বখাটের দায়ের কোপ থেকে মুক্তি, আমি, আপনি ও আমাদের সন্তান কেউ মুক্ত নয়
নেত্রকোণার বারহাট্টায় স্কুলছাত্রী মুক্তি বর্মণের মাথা ও ঘাড়ে ধারাল দা দিয়ে পরপর ৫টি কোপ দিয়ে হত্যা করেছে বখাটে কাউসার। প্রথম ২ কোপ ছাতা দিয়ে আটকালেও পরের ৩ কোপ আর ফেরাতে পারেনি মুক্তি। তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ১৫ বছরের কিশোরীটি।
মুক্তির বন্ধুরা তার সঙ্গেই ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে এই বীভৎস দৃশ্য দেখেছে তারা। ছোট ছোট মেয়েগুলো ভয়কে তুচ্ছ করে বন্ধুকে বাঁচাতে চেষ্টা করেও পারেনি। মুক্তির প্রতি যা ঘটেছে, তা দেশে নতুন নয়।
এদেশের মেয়েরা প্রতিনিয়ত এ ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এসব নিয়ে কথা হচ্ছে, বিচারের দাবি জানানো হচ্ছে, বিচারের প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না।
এর আগে সিলেটে খাদিজাকে একইভাবে কুপিয়েছিল বদরুল। এরও আগে মধুখালিতে চম্পা রানী বণিক দুবৃর্ত্তদের হাতে মারা গিয়েছিলেন এক কিশোরীকে বাঁচাতে গিয়ে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১২৪ নারী ও মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পরে মারা গেছেন ১২ জন, আত্মহত্যা করেছেন একজন।
এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৪ জন। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪০ জন। ২২৫ শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের ২৩ জনের বয়স ৬ বছরের কম, ৪৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
আমাদের কাছে এগুলো সংখ্যামাত্র। এতে দেশের কারো কিছু এসে যায় না, কোনো কিছু থেমেও থাকে না। মুক্তি বর্মণ হত্যার ঘটনায় কাউসার মিয়াকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বহু বছর ধরে এরকম অসংখ্য মামলা হয়েছে। কোনোটায় অপরাধী ছাড়া পেয়েছে, কোনোটায় জামিনে আছে, কোনোটায় অভিযুক্ত ব্যক্তির দায় প্রমাণিতই হয়নি, কোথাও বাদী ভয়ে মামলা তুলে নিয়েছেন, কখনো বা মামলাই হয়নি, সালিশ করে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ধর্ষণকারীর সঙ্গে।
টাঙ্গাইল শহরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব যখন ধর্ষণ মামলার অভিযোগে পরস্পরের মুখোমুখি, তখন ধর্ষণের শিকার কিশোরী বলেছেন—রাজনীতি নয়, তিনি চান ন্যায়বিচার। ছোট মেয়েটি সাহস করে ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনলেও বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন।
নির্যাতনের শিকার নারীর বিচার পাওয়ার হার কমে গেছে। ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়েছে, ৩ বছর ধরে সারাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা কমছে। এর কারণ কিন্তু অপরাধ কমে যাওয়া নয়। আইনজীবী এবং নির্যাতনের শিকার নারীরা বলছেন, নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও অনেক সময় তা মামলা হিসেবে নেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে সালিশ করে অভিযোগ মীমাংসা করে দেওয়া হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনার দাবি রাখে। তা হলো—মুক্তি বর্মণের মৃত্যু কি বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে? আমি মনে করি, পারে। কারণ, বাল্যবিয়ের উদ্যোগ যারা নেন, এরমধ্যে শতকরা ৭৮ শতাংশ বাবা-মা ও অভিভাবক। তারা অনেকেই জানেন যে বাল্যবিয়ে খারাপ। কিন্তু মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিয়ে দিতে পারলেই নিজেদেরকে নির্ভার মনে করেন।
মুক্তি স্কুল থেকে ফেরার পথে বখাটের হাতে নিহত হলো। যে সহপাঠীরা ওই দৃশ্য দেখেছে, তাদের বাবা-মায়েরা যদি নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন, তাহলে আমাদের কী বলার থাকতে পারে? মেয়েশিশুদের পথ চলাচলে ও জীবনযাপনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে বাল্যবিয়ে ঠেকানো খুব কঠিন হবে।
এ বছরও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। পরপর কয়েক বছর এমনই ফল আসছে। বাল্যবিয়ের হার বেশি, বিশ্বে এরকম ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। মেয়েশিশুরা যে কতটা অসহায়, তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।
আমরা যারা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, কথা বলি, কাজ করি—তারা জানি যে কেন তড়িঘড়ি করে গ্রামে বাচ্চাগুলোকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে বড় একটি কারণ নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্য।
যেসব মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে থাকে, তাদের প্রায় ৫০ শতাংশের বয়স ১৬-১৭ বছরের মধ্যে। শতকরা ৪৭ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১৩-১৫ বছরের মধ্যে। ১ দশমিক ৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১০-১২ বছর বয়সে। এই সংখ্যা ২০২০ বা ২০২১ সালের হলেও এখনো কার্যকর।
এবার আসি ফতোয়া প্রসঙ্গে। কয়েকদিন আগে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৩০ বছরের এক নারী। ঘটনার পর মেয়েটি গ্রামছাড়া। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনায় মামলা করার পর থেকে বাদী ও তার পরিবারকে মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্যাতনের শিকার ওই নারীর কয়েকটি ভিডিও ছড়িয়ে দেয় এক অটোরিকশাচালক। তার কোনো বিচার না করে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সালিশে ওই নারীকে ৮২টি বেত্রাঘাত করা হয়েছে। তার ওপর ৮০টি পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। একইসঙ্গে সেই নারীকে ১ মাস ঘরে অবরুদ্ধ থাকার আদেশও দেওয়া হয়।
এ ছাড়া, সালিশকারীরা ঘোষণা দেয় যে সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঘর থেকে বের হলে তাকে আরও ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে। ভুক্তভোগী নারী ভয়ে ঘরে থেকে চিকিৎসা নেন।
একদিকে ভুক্তভোগী নারী বিচার না পেয়ে বাড়ি ছাড়া, অন্যদিকে সালিশকারীরা মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সভ্যতা ও অর্জনের এরকম একটা সময়ে এসে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা আমাদের ব্যথিত, মর্মাহত ও চরমভাবে ক্ষুব্ধ করলেও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা দূরাশাই থেকে যাচ্ছে।
চুনারুঘাটের ঘটনার সঙ্গে ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানেও অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সালিশে এক গৃহবধূকে দোররা মারার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার পর ওই নারী আত্মহত্যা করেন।
২০০০ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আছে। কিন্তু আদালত ঐতিহাসিক রায় দেওয়ার পরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবছরই ফতোয়ার নামে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
প্রভাবশালীদের চাপ উপেক্ষা করে মামলা করা হলেও বিচার শুরুর আগেই বেশিরভাগ আসামি মুক্তি পাচ্ছে। বিচারে দেরি, জামিনে মুক্তি পেয়ে হুমকি, সালিশে মীমাংসা করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, রাজনৈতিক আশ্রয় ও দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে বাদীরা মামলা থেকে পিছু হটছেন।
রায়ের পর সাজা পাচ্ছে মাত্র অল্প কয়েকজন। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আমাদের দেশে নারীর অধিকার সুরক্ষায় অনেক আইন থাকলেও নারী নির্যাতন, নিপীড়ন ও নারীর প্রতি বিচারহীনতার পরিমাণ কোনোভাবেই কম নয়। অপরাধীরা ফাঁক গলে বের হয়ে যায় বলে অপরাধ না কমে, বেড়েই যাচ্ছে।
যেহেতু বিচার পাওয়ার হার কম, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, বিচার পেতে গেলে অনেক ঝামেলা ও টাকা-পয়সার দরকার হয়, তাই নারীরা বিচারের দাবি জানাতে ভয় পান। অধিকাংশ নারী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তেমন সমর্থন ও সহযোগিতা পান না।
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারী ও মেয়েদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে পাবলিক প্রসিকিউশন সিস্টেমকে শক্তিশালী করা দরকার বলে মনে করেন নারীবিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞরা। আমরা দেখছি জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার নারী ও মেয়েশিশুদের অধিকাংশই তাদের সঙ্গে সংঘটিত অপরাধের বিচার চাইতেই অক্ষম।
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ নিশ্চিত করতে বিচারে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এই বিচারহীনতা শুধু নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের হিসাব বা মাত্রা নয়, এর চেয়েও আরও বেশি—এটা এক ধরনের অপরাধ। আজকে মুক্তি নিহত হচ্ছে, অতীতে নিহত হয়েছে মিতু, আগামীকাল হয়তো হবে অন্য কেউ। আপনি, আমি বা আমাদের মেয়েরা কেউ নিরাপদ নয়।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা যেমন অসংখ্য, বিচার পাওয়ার হার ঠিক তেমনিই কম। অথচ বাংলাদেশে নারী সুরক্ষায় কঠোর আইন আছে, নারীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নও বেড়েছে। শ্রমবাজারে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। বড় বড় পদে নারী আসীন হয়েছেন এবং ব্যবসা করছেন।
এতকিছুর পরও দেশে নারী নির্যাতন কমছে না। পারিবারিক সহিংসতার বাইরে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, যৌন উদ্দেশ্য, যৌন ইচ্ছা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া, অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ ইত্যাদি কারণে নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। জরিপে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া শতকরা ৬৬ জন নারী বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে—'বিচার হবে', 'বিচার পাব' এই কথাগুলো নির্যাতিত নারী ও তাদের পরিবার বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই অনেকেই বিচার চান না। নারীদের আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই বাস্তবতার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীবিদ্বেষ দূর করা, নারীদের কথা বিশ্বাস করা এবং অভিযোগের স্বাধীন তদারকি ও যাচাই করতে হবে। ভিকটিম সাপোর্টের পারিবারিক নির্যাতন বিভাগ ও এনজিওগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে।
ভিকটিম ও তাদের পরিবারের যখন দেশের আইনকানুনের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়, তখন একদিকে যেমন অপরাধী শক্তিশালী হয়ে উঠে, অন্যদিকে বিচার চাওয়ার হারও কমে যায়। এটি একটি বাস্তব সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা নতুন নয়। এর পেছনে নিঃসন্দেহে দীর্ঘদিনের সংঘটিত নির্যাতনের অনেক গল্প আছে, আছে বিচারহীনতার গল্পও।
আমাদের দেশের মেয়েরা বারবার শুনে আসছেন যে, তাদের পক্ষে অনেক আইন আছে, নতুন আইন হচ্ছে এবং এসব বিষয় পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নারীরা আরও বেশি নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছেন। আর যারা সাহস করে অভিযোগ করেন, প্রায় সময় তাদের হতাশ করে দেওয়া হয়। তাদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না এবং তাদের কথাও শোনা হয় না। অনেক সময় ভিকটিমকে নিয়ে হাসাহাসি ও কটূক্তিও করা হয়।
এসবের ফলেই বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে চাকরি করার স্বপ্নপূরণ হলো না মুক্তির। বখাটের দায়ের কোপে অকালে সে ঝরে গেল। এভাবেই এক কিশোরীর জীবনের মুক্তি ঘটল। যে মেয়েটি ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ানোর কথা ভেবেছিল আজকে, তার যে মুক্তি ঘটল, সেই মুক্তি কেউ চায়নি।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগকর্মী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments