ভোটের ২৪ মডেল: চক্করে উত্তর কোরিয়া

বাংলাদেশে আগের কোনো মডেলের সঙ্গে সামনের মডেল সম্পর্কে ধারনা পাওয়া কঠিন।

গত অর্ধশত বছরে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপিরও নানান কলসাইন। মাগুরা, মীরপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিনা ভোট, রাতের ভোট ইত্যাদি। সালশা নির্বাচন নামও আছে। সামনে অপেক্ষা করছে কোন মডেল?

এ নিয়ে প্রশ্ন ও তাপদাহ পজিশন-অপজিশন দুদিকেই। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অবাধ-গ্রহণযোগ্য-আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত নির্বাচনের কড়া তাগিদ যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের। কিন্তু, সেই ভোটের ধরন সম্পর্কে ধারণা এখন পর্যন্ত একেবারেই অন্ধকারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার থেকে বলা হচ্ছে, সামনে একটি মডেল নির্বাচন হবে। মাস কয়েক আগে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের কাছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন মডেল নির্বাচনের ওয়াদা দিয়ে এসেছেন। বিদেশিদের কাছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়াদার পর নিয়মিত এ আশ্বাস শোনাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জিজ্ঞাসা এখানেই—কেমন হবে সেই মডেলটা, যা দেখার বাকি আছে? যা আর হয়নি বাংলাদেশে?

১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সকল প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। খাসপছন্দের খন্দকার মোশতাককে (পরবর্তী নাম খুনি মোশতাক) জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি ৪ ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরও নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়।

নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর ৯১ তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। তবে, ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়া আজকের ক্ষমতাসীনদের কাছে সেটি ছিল সূক্ষ্ম কারচুপির মডেল। এর মাঝেই গণ্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মীরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দিনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ।

এর আগে, ২০১৪ সালে বিনাভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। যারা এখন মডেল নির্বাচনের ওয়াদা শোনাচ্ছেন তারা একবারও বলছেন না ১৪ বা ১৮ সালের মডেলটি ঠিক ছিল না। বরং ১৫৪ জনকে বিনা ভোটে পাসের পক্ষে জোরালো যুক্তি তাদের। ২০১৮ সালে রাতে ভোট হয়নি, রাতের ভোটের কোনো প্রমাণ নেই বলে দাবিও করছেন। এ অবস্থায় তারা এবার কোন মডেল দেখাবেন, তা কেবল বিরোধী দল নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও প্রশ্নবোধক।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্যারান্টি দিয়ে বলছেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগের জনের অঙ্গীকার ছিল ১৮ সালে ১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাস করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন, বিনাভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। আশা বা ধারণা করা যায়, ২৪ এর নির্বাচনে বর্তমান সিইসি তার ওয়াদা মতো রাতের ভোটের রেকর্ড ভাঙবেন, ভোটের কাজটি দিনেই করাবেন-করবেন। কিন্তু সেটা নতুন কোন মডেলে?

বাস্তবতা এখন অন্যরকম। ২০১৪-১৮ সালের মতো ভোটকাণ্ড এবার সম্ভব হবে না বলে ধারণা অনেকের। ধারণাটা অনেকের কাছে বিশ্বাসের পর্যায়ে। এমন ধারনা ও বিশ্বাস অনেক কারণে। চলমান স্নায়ুযুদ্ধের এ সময়ে একতরফা কিছু করার সুযোগ এখন রুশ-উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের নেই। গোটা দুনিয়ায় উদাহরণসহ শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা পাল্টে গেছে। কোথাও কোথাও শত্রুই বন্ধু, বন্ধুই শত্রু। অথবা গতকালের বন্ধু আজ শত্রু।

সেই হিসেবে বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। নানা কারণে অনেকের চোখ বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের দিকে। গাজীপুরের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও তাই কেবল জাতীয় নির্বাচন নয়, আন্তর্জাতিক কোনো নির্বাচনের কাছাকাছি। ভৌগলিক, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশেরই চোখ বাংলাদেশের ২৪ সালের নির্বাচনের দিকে।

এসব কারণে বাংলাদেশে আগের কোনো মডেলের সঙ্গে সামনের মডেল সম্পর্কে ধারনা পাওয়া কঠিন। আবার বিএনপি বা কোনো দলের পক্ষে দেশজ শক্তিতে তোলপাড় ঘটিয়ে দেওয়ার সামর্থ্যও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত নেই। নির্বাচনে না যাওয়া বা নির্বাচন ঠেকানোর মতো পথে যাওয়ার রাস্তা নেই তাদের। আবার আগের মতো তাদের বাইরে রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পথ নেই সরকারেরও।

কদিন আগে, নির্বাচনের মডেল হিসেবে যোগ হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচন ও সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির নির্বাচন। সদ্য সম্পন্ন গাজীপুর সিটি নির্বাচন একদম তাজা মডেল। এ নিয়েও বিরোধী দলের কিছু কথা আছে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির কারণে সরকার সেখানে একটি লোক দেখানো সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে। তাহলে ভোটের আর কী মডেল থাকতে পারে?

এমন প্রশ্নের মাঝে ধারনার বোমা ছুঁড়লেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন। বিনাভোটে নির্বাচন নয়, বিনা নির্বাচনেই নির্বাচনের এক আচানক ধারণা দিলেন তিনি।

নির্বাচন ছাড়াই আরেকটি সরকারকে নির্বাচিত করে ফেলার তার তত্ত্বটি সরকারের দিক থেকে অ্যাসিড টেস্টের মতো বাজারে ছাড়া হয়েছে, নাকি তিনি বলার জন্যই বলেছেন—তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিনা ভোটে নির্বাচন হতে পারলে বিনা নির্বাচনেও নির্বাচন হতে পারে—এমন একটি বার্তা ও যুক্তি রয়েছে তার তত্ত্বের মাঝে। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটি।

নির্বাচন ছাড়া এ সংসদ ও সরকারকে আরও ৫ বছর টেনে নেওয়ার ফর্মুলাটির পক্ষে ভেতরে-ভেতরে কারো সায় আছে কি না, তা অপেক্ষা করে দেখার বিষয়। তবে, রাস্তাঘাটে মানুষের মাঝে ভোট নিয়ে হালকা মশকরা আছে। এভাবেই ভোট হলে এতো টাকা খরচের কী দরকার- এতো দাঙ্গা-ফ্যাসাদ না করে ভোট আর লাগবে না মর্মে একটি আইন করে নিলেই তো হয়। ক্ষোভ-বিরক্তি থেকেই এমন স্থূল কথার জন্ম। এরশাদ আমলেও এমনতর খেদ-ক্ষোভ ছিল মানুষের মাঝে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে 'নির্বাচন ছাড়াই নির্বাচন' এর তত্ত্ব দেওয়া অধ্যাপক জামাল সেরকম কোনো ক্ষোভ থেকে কথাগুলো বলেছেন মনে করা যায় না। তিনি অন্তপ্রাণে সরকারপন্থী। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্‌দীন হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন। পরে হয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। এখন আওয়ামী লীগপন্থী নীল দল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতিও। নির্বাচন কেন একটি অনুৎপাদিত খাত, এতে কতো টাকা নষ্ট হয় সেদিকেও আলোকপাত করেছেন সরকারের খাস পছন্দের এই শিক্ষক।

তার এমন তত্ত্বের মাঝে উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনী মডেলের হালকা ছাপ দেখছেন কেউ কেউ। উত্তর কোরিয়ায় অল্প খরচে সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়। হানাহানি হয় না। কারচুপি-জালিয়াতির প্রশ্ন ওঠে না। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিম পরিবারের বংশ পরম্পরায় শাসন করা দেশটিতে ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি অবাধে, অংশগ্রহণমূলকভাবে আনুগত্য দেখায়। সেখানকার জনগণ, প্রশাসনসহ সবমহল এতে অভ্যস্ত। ৫ বছর পর পর সুষ্ঠু, সুন্দর, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সুশৃঙ্খলভাবে তারা ভোট দেয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই ভোটকেন্দ্রে চলে যায়। দাঁড়িয়ে যায় বিশাল লম্বা লাইনে। ভোট দিয়ে চলে যায় না। কেন্দ্রের সামনে সবাই মিলে আনন্দ করে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে বলে স্লোগান দেয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

5h ago