পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

শিশু ও কিশোরদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া, যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার ৯০ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।

বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় ১ থেকে ৪ বছরের শিশুরা এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো ৫ থেকে ৯ বছর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়ে শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ ছেলে শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহারযোগ্য। কিন্তু, এমন মৃত্যু পরিহারে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অপেক্ষাকৃত কম।

বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, ১ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের অপমৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু, যা যৌথভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি ও কলেরার কারণে মৃত্যুর চেয়েও বেশি।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো:

১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব

২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব

৩. অতি দরিদ্রতা

৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব

৫. শিশুদের সাঁতার না জানা

বাংলাদেশে ৮-৯ বছরের শিশুদের সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। যদিও একটি সুস্থ শিশুকে ৪-৫ বছর বয়স থেকেই সাঁতার শেখানো উচিত। পুকুর, ডোবা, খাল, বালতি ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সী শিশুরা পানি ডুবে মারা যায়।

২০২২ সালের এক গবেষণায় হোসাইন ও তার সহযোগীরা দেখতে পান, ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের ৮০ শতাংশই বসত ঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো পুকুর-জলাশয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। বাংলাদেশে একাধিক শিশু, বিশেষভাবে যমজ শিশুদের একই স্থানে একইসঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়। এতে বোঝা যায়, শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশল, বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সম্পর্কে সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় না।

সচেতনতার অভাব, বয়স্কদের দ্বারা শিশু তত্ত্বাবধানের অভাব এবং অবহেলাকে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক সময় শিশুদের নিরাপদ মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন হয়। যেমন: অনেকে মনে করেন, তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যাবে না, কারণ তারা অত্যন্ত ভালো পিতা-মাতা। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আগে এমন চিন্তাই করেন মা-বাবারা। কেউই ভাবেন না যে তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে।

সঠিক তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো শিশুই পানি থেকে নিরাপদ নয়। অনেকে তাদের ছোট সন্তানকে বড় সন্তানের তত্ত্বাবধানে রেখে নিশ্চিন্ত অনুভব করেন। কিন্তু, এমন সময়েও অনেক শিশু মারা যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষের বসত বাড়িতেও শিশুদেরকে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, আপনি আপনার সন্তানের প্রধান নিরাপত্তাকারী।

অনেকে মনে করেন, শিশু সাঁতার জানলেই সে পানিতে নিরাপদ। কিন্তু, বাস্তবতায় দেখা যায়, সাঁতার জানা শিশুরাও অনেক সময় পানিতে একা বিপদে পড়ে। যাদের ধারণা, তাদের শিশু সবসময় তাদের সঙ্গে বাসায় থাকে, তাদের মনে রাখা দরকার যে শিশুরা অত্যন্ত দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। আপনার অগোচরেই হয়তো শিশু কোনো জলাশয়ে পড়ে যেতে পারে। পানিতে ডুবে যাওয়া অত্যন্ত নীরব ঘটনা। শিশুরা পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় কোনো আওয়াজ বা সাহায্য চাইতেও পারে না বেশিরভাগ সময়। ফলে শিশুরা নীরবে পানিতে ডুবে মারা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ৬টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে:

১. প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুদেরকে পানি থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ

২. পানিতে যাওয়ার পথে বেষ্টনী প্রদান

৩. সাঁতার শিখানো এবং পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদান

৪. বন্যা ও অন্যান্য পানি থেকে সংঘটিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা

৫. পানি থেকে শিশুদেরকে নিরাপদে উদ্ধার এবং সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান

৬. বোট, জাহাজ ও ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকরী বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠাকরণ

এই ৬টি নিবারণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪টি কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো:

১. বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকাণ্ডে সমন্বিতভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বিবেচনা করা

২. কৌশলগত যোগাযোগের মাধ্যমে গণ সচেতনতা বৃদ্ধি করা

৩. তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণার মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে সৃজনশীল কৌশল প্রণয়ন করা

৪. জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যু হারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণাসহ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু সংশ্লিষ্ট মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক উল্লেখ করে নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য জোর দিয়েছে।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিহার বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

২০২৩ সালের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে 'যে কেউই পানিতে ডুবে যেতে পারে, কারো ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়'।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জন স্বাস্থ্য ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট মৃত্যু মোকাবিলায় দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রস্তুতি এবং নিবারণমূলক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে কার্যক্রম অত্যন্ত অপ্রতুল। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৬ ও ২০১৩ সালে রায়গঞ্জ, শেরপুর এবং মনোহরদী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কমিউনিটি ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) এবং সাঁতার প্রশিক্ষণকে কম খরচে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণের কার্যকরী কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই দুটি নিবারণ কৌশলের মাধ্যমে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করলে আরও বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে বাস্তবায়িত আরও একটি প্রকল্পে কোনো এলাকায় একই সঙ্গে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করলে শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্য নীতিতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুও বিবেচনা করলেও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত।

ডিজাস্টার অ্যাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (দাদু) পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জনসচেতনতা এবং মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাঁতার প্রশিক্ষণ এবং জলাধার থেকে সুরক্ষা কৌশল শিখানো, অনিরাপদ জলাধারে বেষ্টনী প্রদান এবং কমিউনিটি ডে কেয়ার স্থাপনে কাজ করছে।

অর্থ সংকট, বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রদানকৃত নিবারণ কৌশলকে দেশব্যাপী বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করা যেতে পারে।

সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই শিশুমৃত্যু নিবারণে ভূমিকা পালন করতে পারি। এর জন্য আমরা যা করতে পারি তা হলো:

১. শিক্ষা ঘর থেকে শুরু হয়। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা

২. বাড়িতে শিশু পানি থেকে নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ করা

৩. পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ভয়াবহতা বিষয়ে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করা

৪. বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার অন্য বিষয়ের সঙ্গে এই বিষয়টি উপস্থাপন করা

৫. প্রতিবেশীদের শিশুরা নিরাপদ কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা

৬. উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করা

৭. জলাধারের পাশে বেষ্টনী প্রদানের ব্যবস্থা করা

৮. নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা এবং অন্যকেও উৎসাহ প্রদান

৯. আর্থিক সক্ষমতা থাকলে দরিদ্র পরিবারকে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর প্রদান

১০. শিশুদেরকে সাঁতারের শেখানোর ব্যবস্থা করা (একটি সুস্থ শিশু ৪-৫ বছর বয়স থেকে সাঁতার শেখা শুরু করতে পারে)

১১. ইউটিউব এবং স্বীকৃত প্রশিক্ষকের কাছ থেকে সিপিআর প্রশিক্ষণ

১২. নিজ এলাকায় যুবকদের সমন্বয়ে ক্যাম্পেইন দল গঠন

১৩. জাতীয় জনসচেতনতা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ

১৪. নিজ এলাকায় কমিউনিটি ডে কেয়ারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা এবং সম্ভব হলে বাস্তবায়ন করা

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অরগানাইজেশন ও বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অবদান জরুরি।

প্রফেসর ড. মো. ইদ্রিস আলম, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রধান নির্বাহী ডিজাস্টার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (দাদু), বাংলাদেশ

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

11h ago