নারী ফুটবলে অ্যাসিড সন্ত্রাসের হুমকি
অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান কি শক্ত? সেই বিষয়ে পরে আসছি। জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবসময় ছিল সরব। অ্যাসিড সন্ত্রাস কমেছে বলে যারা ভাবছেন, তাদের জন্য তথ্য হলো, ২০০২ সালে আইন প্রণয়নের পর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমেছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ও নজরদারির দুর্বলতায় ২০২২ সালে আবার তা বেড়েছে। ২০২৩ সালে গণমাধ্যমে একাধিক ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্যমতে, ২০২২ সালে অ্যাসিড সহিংসতার ১৭টি ঘটনায় ২৭ জন দগ্ধ হন। এর মধ্যে ১৬ নারী, ৯ পুরুষ ও দুই শিশু রয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে ৩ হাজার ৮৭০ জন অ্যাসিডদগ্ধ হন। ১৯৯৯ সালে ১৬৮ জন অ্যাসিডের শিকার হন। ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৪৯৬ জন দগ্ধ হন। ২০০৩ সাল থেকে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তির সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ২২, ২০১৯ সালে ২১, ২০২০ সালে ২২, ২০২১ সালে ১৯ ও ২০২২ সালে বেড়ে ২৭ জন হয়েছে।
সাধারণত কাদের অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয়? নারীদের। কেন মারা হয়? ব্যক্তিগত আক্রোশ, ক্ষোভ, আশা, প্রেম, বিয়ে, সম্পত্তি, হতাশা ইত্যাদি কারণে। মোটাদাগে বলা যায়, ব্যক্তিগত কারণেই অ্যাসিড সন্ত্রাস বা অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এবার ভিন্ন বিষয় চোখে পড়ল।
হাফপ্যান্ট পরে খেলার জন্য মারধরের পর এবার কিশোরী ফুটবলারদের অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দিচ্ছে অভিযুক্তরা। ঘটনার কেন্দ্র খুলনার বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা গ্রাম। সাদিয়া নাসরিন জেলা অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবল খেলোয়াড়। বটিয়াঘাটা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া ও অন্য কিশোরীরা স্থানীয় 'তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমি'তে অনুশীলন করে।
গত ২৭ জুলাই একাডেমিতে অনুশীলন করার সময় নূপুর খাতুন নামে এক প্রতিবেশী সাদিয়ার ছবি তোলেন। সাদিয়ার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে সেই ছবি দেখিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে আসেন নূপুর। সাদিয়া ২৯ জুলাই সন্ধ্যায় বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নূপুর অকথ্য ভাষায় তাকে গালাগাল করে। প্রতিবাদ করলে তাকে এলোপাতাড়িভাবে কিল, চড়, ঘুষি মেরে বিভিন্ন স্থানে জখম করা হয়।
সাদিয়া ভাষ্য, 'বাড়িতে গিয়ে আমি বাবা-মা, কোচ ও অন্য খেলোয়াড়দের ঘটনাটি জানাই। তারা আমাকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে নূপুর খাতুনের বাড়িতে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নূপুর, তার বাবা নূর আলম খাঁ, ভাই সালাউদ্দিন ও নূপুরের মা রঞ্জি বেগম আমাদের ওপর হামলা করে। এতে মঙ্গলী বাগচী, হাজেরা খাতুন ও জুঁই মণ্ডল আহত হয়। তারা লোহার রড দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়, চায়নিজ কুড়াল নিয়ে এসে হত্যার হুমকি দেয়।' (সমকাল, ৩ আগস্ট ২০২৩)
ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। ঘটনার পরদিন সাদিয়া নাসরিন বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করে। এবার হামলাকারীরা ভয়ংকর উগ্র আচরণ করতে থাকে। মেয়ে হয়ে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেললে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া এবং অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দিচ্ছে। কতটা সাহস পেলে তারা এই ধরনের কথা বলে আমি বুঝি না।
আমি ঠিক বুঝি না, ভয়ংকর হুমকি দেওয়ার পর নারী সংগঠনগুলো করছে কী? অবশ্য বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শওকত কবির জানান, নূর আলম বর্তমানে কারাগারে। তবে অন্য ৩ আসামি মঙ্গলবার আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। এসিড নিক্ষেপের হুমকির অভিযোগে সাদিয়া ৩১ জুলাই একটি জিডি করে। মামলা ও জিডির তদন্ত চলছে।
এইসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) কী করছে? আজকে যদি সাদিয়া খাতুন, মঙ্গলী বাগচী, হাজেরা খাতুন ও জুঁই মণ্ডলের বড় কোনো অর্জন থাকত তখন বাফুফে বলত, সব তারাই করেছে। অথচ শুধু হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলার জন্য গ্রামের কিছু উগ্রলোক অ্যাসিড ছুড়ে মারার হুমকি দিয়েছে, অথচ বাফুফের ঘুম ভাঙেনি। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন জয়ী নারীদেরও এই ধরনের সংকটে পড়তে হয়েছিল, সেইসময়ও বাফুফে কিছু করেনি। নারীরাই তাদের সমাধান খুঁজে নিয়েছে। বাফুফে অবশ্য কখনোই কোনো সমাধান দিতে পারে না।
শুধু বাফুফে কেন? দেশে নারীদের উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, অগ্রযাত্রার কথা সরকারি লোকজন বলতে বলতে গলা ফাটিয়ে ফেলে। পত্রিকা থেকে টেলিভিশন, টেবিল টক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব জায়গায় শুধু নারীদের জয়জয়কার। সরকারি লোকজনের কথা শুনলে মনে হয়, দেশে নারীদের কোনো সমস্যা নেই। সবাই ফুরফুরা মেজাজে ঘুরছে অথচ খুলনায় নারীদের হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলার কারণে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়াসহ অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
কোন সমাজব্যবস্থায় আমরা বাস করছি ভাবুন একবার। 'বাউল গান গায়, মোমবাতি জ্বালায়, ন্যাড়া করে উচিত শিক্ষা দিয়েছি' (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১)। কুষ্টিয়ায় বাউলদের ওপর হামলা, আহত ৮ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৬ নভেম্বর ২০২২)। চুয়াডাঙ্গায় বাউলদের ওপর একের পর এক হামলা, পান না বিচার (প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। বেলাবতে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কাঁদছেন লালনশিল্পীরা (প্রথম আলো, ৯ মে ২০২৩)। নরসিংদীতে সাধুর আশ্রমে হামলা, ভাঙচুর (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৮ মে ২০২৩)।
এই দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে লালন উৎসব করা হয়, অথচ বাউল নির্যাতন, সাধুসঙ্গে আক্রমণ বা বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দিলে কারো প্রতিবাদ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের গলা তো আগেই ধরে আসে। এসব ক্ষেত্রে তারা কী বলবে, কিছুই জানে না যেন। যখন হেফাজতের মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে চেয়েছিল, তখনো তাদের মুখে কোনো কথা ফুটেনি। তারা বোঝেনি তা নয়, নীরব থেকেছে ভয়ে।
আর পোশাকের কারণে নারীর শ্লীলতাহানি তো অহরহ। নরসিংদীতে 'রেলওয়ে স্টেশনে তরুণীকে হেনস্তা, "অভিযোগ না পাওয়ায়" তৎপরতা নেই পুলিশের' (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২২)। 'টিপ পরছোস কেন' বলেই বাজে গালি দেন পুলিশের পোশাক পরা ব্যক্তি (প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল ২০২২)।
লক্ষ্য করবেন এসব ঘটনার বিচার কিন্তু হয় না। তাহলে কেন নারীদের বিরুদ্ধে টিপ্পনী কাটা, পোশাকের কারণে শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং—এসব অহরহ ঘটবে না? বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি এক-দেড় দশকে গড়ে উঠেছে, তা ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকারি নথিতে এসব কিছুই নেই।
শুরু করেছিলাম অ্যাসিড সন্ত্রাস দিয়ে। ২০০২ সালে যখন অ্যাসিড নিক্ষেপের আইন করা হলো, এই বিষয়ে ঘটনা কমতে শুরু করে দিলো। তার মানে বিচার হলেই সমাধান মিলবে। তাহলে বিচার হয় না কেন? তার উত্তর কি দিতে হবে?
বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ আয়োজন করা হয়েছিল নারীদের খেলার জন্য। আইডিয়াটা দারুণ। কিন্তু বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ যে উদ্দেশ্য চালু করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্য কি সাধিত হলো? যদি সবাই নারী ফুটবলের পক্ষে হয়, তাহলে বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছে, গ্রাম ছাড়া করা হুমকি দিচ্ছে, অ্যাসিড ছুড়ে মারার হুমকি দিচ্ছে, তারা কারা? তাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ হচ্ছে না কেন?
মঙ্গলী বাগচী বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ খেলেছিল। পরে ছিটকে পড়ে। অথচ মঙ্গলী বাগচীসহ তার সতীর্থরা এখন আঘাতপ্রাপ্ত, ভীত। তার মানে সামগ্রিকভাবে যে মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন, তা করতে পারেনি এই শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন, সরকার বা রাষ্ট্র। তাহলে এসব বড় আয়োজন করে কী লাভ?
নারীদের প্রতি এই ধরনের উগ্র মানসিকতা আজ নতুন নয়। আগেও বিভিন্নভাবে হয়েছে। প্রতিবাদ হয়নি, শাস্তি হয়নি। ফলে এসব উগ্রচিন্তার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এই মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক বিশ্ব জয় অসম্ভব, ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় সর্বোচ্চ।
বিনয় দত্ত: কথাসাহিতিক ও সাংবাদিক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments