বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রা নীতি

মূল্যস্ফীতি কমার আভাস নেই, প্রলম্বিত হবে মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট

প্রতিদিনই বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য বাড়ছে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ‘সবকিছুর’ দাম। বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে ধরতে না পারলে মূল্যস্ফীতিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে আসছে, নির্বাচন শেষে তারা মূল্যস্ফীতির মোকাবিলায় আরও উদ্যোগী হবে।

তবে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তা থেকে বোঝা গেল যে, মূল্যস্ফীতি এখন 'নিউ নর্মাল'। গত কয়েকবছর ধরে জীবনযাপনের দৈনন্দিন খরচের জোগান দিতে হিমশিম খাওয়া দরিদ্র ও নির্ধারিত আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য পরিস্থিতি খুব শিগগির পরিবর্তন হচ্ছে না।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো পলিসি রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো। ২০২২ সালের মে মাসের পর অষ্টম দফায় এই হার বাড়ানো হলো।

এই উদ্যোগ থেকে প্রত্যাশা হচ্ছে, তহবিলের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে আরও ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে তহবিল কম থাকায় শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট ও সাধারণ মানুষের হাতেও তহবিল কম থাকবে। যার ফলে, তাদের সবার কাছে আগের তুলনায় খরচের জন্য কম অর্থ থাকবে এবং তা সামগ্রিক চাহিদা কমিয়ে আনবে।

সামগ্রিক চাহিদা কমে গেলে অর্থনীতিতে যোগান ও চাহিদার নীতি কার্যকর হবে এবং সে অনুযায়ী দামের পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ, এভাবেই মূল্যস্ফীতির মোকাবিলা করা যাবে।

তবে এ ধরনের আশাবাদী চিন্তাধারা কার্যকর হতে পারে মাত্র মূল্যস্ফীতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এমন অর্থনীতির ক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলাদেশ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত। সবচেয়ে বড় কথা, নবগঠিত সরকারের ইশতেহারে পরিষ্কার বলা হয়েছে প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি প্রাধান্য পাবে।

তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এই চিন্তাধারা উপযোগী হতো যদি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতির উদ্ভব হতো।

কিন্তু বাংলাদেশের আমদানি নির্ভর অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।

দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যেসব পণ্য ব্যবহার করে থাকেন, তার বেশিরভাগই আমদানি করা হয় অথবা আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি করা হয়।

প্রতিদিনই বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য বাড়ছে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে 'সবকিছুর' দাম। বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টেনে ধরতে না পারলে মূল্যস্ফীতিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার জানান, মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালুর কথা বিবেচনা করছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর পূর্বশর্ত হলো এই প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে এই প্রক্রিয়া চালু হতে পারে।

কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট করে জানাননি, কবে থেকে এটি চালু হবে। অর্থাৎ, আগামীতেও চলতি ধারা অনুযায়ী বাড়তে থাকবে বিনিময় হার, এবং সেই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

বেশিরভাগ মানুষের মজুরি বাড়েনি এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বড় আকারে কমে গেছে। যার ফলে সার্বিক চাহিদা ইতোমধ্যে নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে, বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতি থামাতে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে চাহিদা আরও কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চিন্তাধারা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ খুব বেশি ফল বয়ে আনতে পারবে না।

যদি এভাবে পলিসি রেট কমিয়ে মূল্যস্ফীতির ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হতো, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারে এই রেট কমিয়ে এক ধাক্কায় সম্পূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতো। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা হলো, বিভিন্ন দিক থেকে অসংখ্য আঘাত পেয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আর সর্বশেষ এই মুদ্রানীতিতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ওপর।

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে শিল্প খাতে ইতিবাচক মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতোমধ্যে এই হার বাংলাদেশের ব্যাংকের আগামী ছয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে। আর এখন যেভাবে তহবিলের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, তাতে এটি আরও নিচে নেমে যাবে।

চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে শিল্প খাতের কাঁচামাল, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য পণ্যের এলসি খোলার সংখ্যা আগের বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে, যা অর্থনীতিতে আসন্ন মন্দার আরও একটি লক্ষণ।

অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে যাওয়ার প্রভাবে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে, এবং এটা কখনোই মূল্যস্ফীতির চাপে জর্জরিত দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভালো খবর হতে পারে না।

এসব ঘটনা এটাই নির্দেশ করে যে, করোনাভাইরাস মহামারির সবচেয়ে কঠোর পরিস্থিতির চেয়েও এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত।

সে সময় আশা করা হয়েছিল যে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এই ভাইরাসকে শিগগির নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং অর্থনীতি আবারও নবজীবন ফিরে পাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল প্রতিক্রিয়ায় এবার আমাদের সামনে সেরকম কোনো ইতিবাচক ভবিষ্যতের হাতছানিও নেই। যার ফলে দীর্ঘসময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা অব্যাহত থাকতে পারে—এই সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

1h ago