নৈঃশব্দের অধিকার ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ

কেউ কি চাইলেই অন্য কাউকে দাস-শ্রোতাতে পরিণত করতে পারেন?
নৈঃশব্দের অধিকার ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ
প্রতীকী ছবি

'ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম দ্রাম' শব্দে খটকা লেগেছিল সুকুমার রায়ের। ভেবেছিলেন সেটা পটকা ফোটার শব্দ। কিন্তু এমন শব্দ করে যে ফুলও ফুটতে পারে, তা সুকুমারের মতো তার ছড়ার পাঠকরাও হয়তো বুঝতে পারেননি শুরুতে। যেমনটি আজও অনেকের কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে না যে, ঠিক কীভাবে 'শাঁই শাঁই' শব্দে ফুলের গন্ধ ছোটে কিংবা 'হুড়মুড় ধুপধাপ' শব্দে বাইরে হিম পড়ে।

শব্দের পৃথিবীতে বসবাস আমাদের। শব্দই প্রাণিকুলের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম৷ এই যন্ত্রকাতর নাগরিক সভ্যতায় শব্দহীন জায়গা তাই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলোর ভেতর কোনো কোনো শব্দ আমাদের হৃদয়-মনকে আন্দোলিত করে, আবার কোনো শব্দ হয়ে ওঠে নিখাদ ভোগান্তির কারণ।

তাই শব্দের সুচারু প্রয়োগ জরুরি। কিন্তু এই ২০২৪ সালে এসে প্রায় দুই কোটি মানুষের এ ঢাকা মহানগরে অবাঞ্ছিত শব্দের অত্যাচার যে মাত্রায় পৌছেঁছে, তাকে কেবল শব্দসন্ত্রাসই বলা চলে। সুতরাং এখন সুকুমারের মতো আশপাশের বিবিধ শব্দ নিয়ে পেলব কোনো ছড়া কিংবা রচনা লেখার কাজটা কঠিনই বটে।

অথচ নতুন শতকের শুরুর দিকেও খোদ ঢাকা শহরের পাড়া-মহল্লার বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসা মোরগ কিংবা পায়রার ডাক, প্রতিবেশীর গলা সাধার আওয়াজ, রিকশার টুংটাং, আইসক্রিমওলার মিষ্টি ঘণ্টার শব্দ, কলপাড়ে পানি পড়ার শব্দ, পাখির কাকলি, ফেরিওয়ালার হাঁকাহাঁকি, হঠাৎ বেজে ওঠা কোনো বাঁশির সুর এমনকি রান্নাঘর থেকে আসা মাছ ভাজার শব্দটিকেও ঠিক আলাদা করে চিনে নেওয়া যেত। এমন প্রতিটি শব্দেরই ছিল আলাদা ব্যঞ্জনা।

এখন সেখানে জায়গা নিয়েছে পঙ্গপালের মতো ছুটে চলা গাড়ির বিকট হর্ন, ইটভাঙা মেশিনের শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, কলকারখানায় সৃষ্ট শব্দ, ট্রেনের হুইসেল কিংবা বিমান ওড়ার শব্দ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চালু থাকা বিরাটাকায় সব যন্ত্র থেকে নির্গত উৎকট সুরবর্জিত সব শব্দের সমাহার। পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় দিন-রাত নির্বিশেষে শহরজুড়ে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সভার যে বক্তৃতা মাইকে মাইকে বহুবর্ধিত হয়ে শ্রোতাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে, তাও শুনতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। এছাড়া নিত্য কোলাহলময় এ শহরে সব ধরনের ভালো-মন্দ বিবেচনা বাইরে রেখে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে সাউন্ডবক্সে উচ্চস্বরে বাজানো গান কতখানি বিরক্তি ও অসহায়ত্বের অনুভূতি এনে দিতে পারে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। সেইসঙ্গে বাজনা-ধ্বনিত বাজার, শপিংমল, বাস কিংবা ট্রেনে অনাহুত শব্দের অত্যাচারের সঙ্গেও কম-বেশি সবাই পরিচিত।

এখন প্রশ্ন হলো—কেউ কি চাইলেই অন্য কাউকে দাস-শ্রোতাতে পরিণত করতে পারেন? মানবজীবনে শব্দের প্রয়োজন যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমন করে নৈঃশব্দও তো জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। কিন্তু এই ঠাসবুনটের নগরে সেই নৈঃশব্দের পরিসরটা ঠিক কোথায়?

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট বলছে, উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি ও স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। কানে শোনার ক্ষমতা কমে যায়, ঘুম কম হয়, বিরক্তির মাত্রা বেড়ে যায়। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিও হয় দীর্ঘ মেয়াদে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত 'স্বাস্থ্যে শব্দের প্রভাব' শীর্ষক ল্যানসেটের ওই প্রবন্ধে বলা হয়, আচমকা শব্দে (ইমপালস সাউন্ড) ও দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দের (৭৫ থেকে ৮৫ ডেসিবেল) মধ্যে থাকলে মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, এতে কানের কোষ (সেল) মারা যায়। কানের কোষ মারা গেলে তা মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কোষ নতুন করে আর তৈরি হয় না।

অথচ সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) এক জরিপে দেখা গেছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার যেসব জায়গাকে 'নীরব এলাকা' ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানেও নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণ মাত্রার উচ্চ শব্দ থাকছে।

গত সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে জরিপের এই ফলাফল প্রকাশ করে পরিজা। এই জরিপের অংশ হিসেবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরের ৪৫টি জায়গার শব্দের মাত্রা মেপে দেখে পরিবেশবাদী সংগঠনটি।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনে (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) শব্দের মাত্রা ৫০ ডেসিবলের নিচে এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪০ ডেসিবেলের নিচে থাকার কথা।

কিন্তু পরিজার জরিপে নীরব এলাকায় দিনে নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণেরও বেশি এবং রাতে আড়াই গুণের বেশি মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান সংগঠনের সভাপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় তারা দিনের বেলায় নির্ধারিত সীমার দেড় গুণ এবং রাতে দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের উপস্থিতি পেয়েছেন। মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে নির্ধারিত সীমার দেড় গুণের বেশি; আর রাতে দুই গুণের বেশি। আর বাণিজ্যিক এলাকাতেও দিনে ও রাতে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত সীমার চেয়ে দেড় গুণ বেশি পেয়েছেন তারা।

পরিজা ঢাকা মহানগরীর যে ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেছে, তার মধ্যে আছে মানিক মিয়া এভিনিউ, আসাদ গেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, আজিমপুর, কলাবাগান, ধানমন্ডি, পান্থপথ, রাসেল স্কয়ার, ধানমন্ডি ২৭, কলেজ গেট, শ্যামলী, আগারগাঁও, পলাশী, লালবাগ সেকশন, নাজিরাবাজার ও সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন এলাকা।

জরিপে নীরব এলাকায় দিনে ৮৪ দশমিক ৫ থেকে ১০১ দশমিক ৭ ডেসিবল এবং রাতে ৯৬ দশমিক ৪ থেকে ১০১ দশমিক ৫ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে। আবাসিক এলাকায় দিনে ৮২ থেকে ৯১ ডেসিবল এবং রাতে ৮৩ থেকে ৯১ দশমিক ৬ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পওয়া গেছে।

মিশ্র এলাকায় দিনে ৯১ থেকে ১০১ দশমিক ৫ ডেসিবল এবং রাতে ৮৯ থেকে ১০৩ দশমিক ৮ ডেসিবল শব্দ পাওয়া গেছে। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৯২ থেকে ৯৭ ডেসিবল এবং রাতে ৯১ থেকে ৯৯ ডেসিবল শব্দের মাত্রা মিলেছে। এছাড়া বাসের ভেতরেও শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেছে পরিজা। তাতে ৮০ দশমিক ৪ থেকে ৮৩ দশমিক ৯ ডেসিবল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে।

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় শব্দদূষণের আওতার বাইরে তেমন কোনো জায়গাই নেই।

পরিজার ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন। এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ হলো— রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন নগর-মহানগরে এমনকি কোনো কোনো গ্রামীণ জনপদেও শব্দদূষণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শব্দদূষণের কুফল বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব এবং শব্দদূষণ প্রতিরোধে যথাযথ প্রশাসনিক নজরদারি ও পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে।

দেশে একটি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি (২০০৬) রয়েছে। ওই বিধির আওতায় ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর সচিবালয় এলাকাকে 'নীরব' এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে এর চারপাশের সড়কে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করে সরকার। কিন্তু পরিজার গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সেখানে ১০১ দশমিক ৭ ডেসিবল পর্যন্ত তীব্রতার শব্দ পাওয়া গেছে।

এখন শোনা যাচ্ছে, সরকার শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা সংশোধন করে হর্ন বাজানোর শাস্তি বাড়ানোর চিন্তা করছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শব্দদূষণের প্রাবল্য একটি শিশুকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বধির হওয়ার পথে নিয়ে যায়। শিশুরা হয়ে ওঠে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত। শেখার ক্ষমতা কমে যায় তাদের।

আমরা কি আমাদের শিশুদের সেই পথেই নিয়ে যাচ্ছি?

প্রতিবেশী দেশ ভারতে সম্ভবত ১৯৯৬ সালে প্রথম রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শব্দদূষণ রোধে আইন পাস করে। সে বছর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেন, বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিসরে না শোনার স্বাধীনতা কিংবা নীরব থাকার স্বাধীনতাও আবশ্যিকভাবে অন্তর্ভুক্ত।

ওই রায়ে কলকাতায় প্রথম রাত ৯টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছিল।

কথা হচ্ছে—আমাদের দেশে এমন নৈঃশব্দের অধিকার, না শুনতে চাওয়ার অধিকারের কথা কে বলবে?

মামুনুর রশীদ: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago