খুনগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাসকগোষ্ঠীকে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ কফিন রেখে গায়েবানা জানাজা, ছবি: স্টার

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকারি হিসেবে খুন হয়েছে ৪৫ জন ছাত্র। ন্যায্য দাবির জন্য এতো কেন প্রাণ ঝরে গেলো। খুনের ক্ষুধা এতো দিন ধরে রাষ্ট্র লালন করেছে? রাষ্ট্র কেবল খুন করে ক্ষান্ত হয়নি তা যে ন্যায্য তা প্রমাণে নতুন নতুন বয়ান হাজির করছে। হত্যাকাণ্ডের শিকারদের নানা ধরনের ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। যেমন-সরকারি বিধিনিষেধ না মানা এবং ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া এসব।

যেমন রংপুরে নিহত আবু সাঈদকে শিবিরকর্মী হিসেবে উপস্থাপন। সরকার সবসময় যে ধরনের বাধ্যনুগত জনগণ চান, জনগণের পক্ষে সবসময় তা হয়ে উঠা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্র এক ‍বৃহৎ সমঝোতামূলক, জনগণ কর্তৃক নির্মিত। কিন্তু নির্মাণের পর রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব থাকছে না। জনগণ ও রাষ্ট্র হয়ে উঠছে পরষ্পর বিরোধী সত্তা। আর রাষ্ট্র হলো এক হৃদয়হীন কাঠামো।

যাহোক, হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কী কোনো ন্যায্য যুক্তি থাকতে পারে? পারে না। খুন তো খুনই। এতোগুলো ছাত্র জীবনের পূর্বান্তে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে কে ভেবেছে? খুন একদম অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা। এক স্বয়ংভূ বর্বরতার ইতিহাস। আর এ ইতিহাস হলো টিপ অব দ্য আইসবার্গ। একটা খুনের ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে বিশেষ সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতি লাগে। সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতির অভাব এবং অসৎ উদ্দেশ্য মিলিয়ে যে কর্তৃত্ব তৈরি হয় এর চেয়ে নির্মম কর্তৃত্ব আর কী হতে পারে?

মানুষ হত্যাকাণ্ডগুলো দেখে ফেলেছে। এসব কোনো গুপ্ত বাহিনী করেনি, করেছে রাষ্ট্রীয় অনুগত দল এবং দিবালোকে। ছাত্রদের উদোমবুক ঝাঝরা করছে বুলেট। পাহাড়সম কষ্ট আজ ভর করছে। জনগণ অন্যায্য কিছু ভুলতে চায় না।

খুনগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাসকগোষ্ঠী ও জনগণকে। শাসকগোষ্ঠী চাচ্ছে কতো তাড়াতাড়ি খুনের ঘটনা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। এ জন্য নতুন নতুন ঘটনা তৈরি করছে। জনগণকে সেই দিকে মনোযোগী করে তোলার চেষ্টা করছে। কথা হলো কর্তৃত্ববাদী শাসনের নিচে ইতিমধ্যে গড়ে উঠছে ঠুনকো জনস্মৃতি যার সর্বোচ্চ আয়ু পনের দিন। যেমন-আকাশ চুম্বী দুর্নীতি খবর, কখনও চন্দ্রবোড়া সাপ বা ৪০০ কোটি টাকা।

জনগণের স্মৃতি ভাঙাচুরা বা তাৎক্ষণিকতার ভেতর থাকতে বাধ্য করার অপচেষ্টায় যে এতে খুব বেশি লাভ যে হচ্ছে তা বলা যাবে না। কারণ, মানুষ হত্যাকাণ্ডগুলো দেখে ফেলেছে। এসব কোনো গুপ্ত বাহিনী করেনি, করেছে রাষ্ট্রীয় অনুগত দল এবং দিবালোকে। ছাত্রদের উদোমবুক ঝাঝরা করছে বুলেট। পাহাড়সম কষ্ট আজ ভর করছে। জনগণ অন্যায্য কিছু ভুলতে চায় না। মেমোরিতে রেখে দিতে চায়। ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনা বিবেকবানদের তাড়া করে ফিরছে। এতো অমানবিকা বাংলাদেশ কেউ চায়নি।

খুনে কেবল ব্যক্তি খুন হয় না, খুন হয় ব্যক্তির বিস্তর গুণ ও অমিত সম্ভাবনা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযুক্তির কারণে অচেনা একজন মানুষের খুনও সে গ্রহণ করে না। প্রতিটি খুন  জনমনস্তত্ত্বে গভীর অভিঘাত তৈরি করে। কবি শামসুর রাহমানের 'না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন' এর একটি কবিতার নাম হলো গুণ খুন।

''যুবাদের বাক্যালাপ শুনে আমার হৃৎপিন্ড শুধু
খাঁচার পাখির মতো ডানা ঝাপটায়
ঘন ঘন। কী করে সবাই ওরা চিনে তাকে
যাকে উন্মত্তাবশে খুন করে দিয়েছে কবর
আমার ঘাটের নিচে। কখনো কখনো মধ্যরাতে
সে হেঁটে বেড়ায়
স্বপ্নচারিতায় ঝুলবারান্দায়, কার্নিশে।''

হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে রাষ্ট্র পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছে দুখের ঝাঁপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা কী তিনি তা খুব ভালো করেই জানেন। দ্য আর্ট অব স্টোরি টেলিং: ফ্রম প্যারেন্ট টু প্রফেশনালের লেখক অধ্যাপক হানা বি. হার্ভে লিখেছেন, ''যখন আমরা পরিবারের কাউকে হারাই তখন তিনি মূলত গল্পের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকেন'' রাষ্ট্র উপহার ‍দিচ্ছে অসংখ্য খুনের গল্প। বাবা-মা,পরিবার-পরিজন বাকি জীবন বেঁচে থাকবে এসব খুনের গল্পের ভেতর, ট্রমার ভেতর।

খুনের পরিসংখ্যান নিকষ, কালো ও খটমটে। এগুলোর ভেতর ব্যক্তির মুখ নেই। বাস্তবতা হলো প্রতিটি খুন বেঁচেবর্তে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের দীর্ঘপ্লট। কারণ তারা ছিল পরিবারগুলোর আগামীর আশ্রয়, নির্ভরতা ও বেঁচে থাকার অবলম্বন। মুহুর্তের মধ্যে পরিবারে সে স্বপ্ন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে।  হত্যার গড় পরিসংখ্যান মোটের ওপর চোখ বুলাতে শেখায়, কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তির ওপর নয়।

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জীবন যেমন অনন্য, তেমনি প্রতিটি মৃত্যু স্বতন্ত্র। জীবন বা মৃত্যুর কোনো গড় হিসাব হয় না। সম্প্রতি হত্যাকাণ্ড গড় হিসাব কষতে শিখাচ্ছে। খুনের শিকার ছাত্রদের বহুমাত্রিক পরিচয়ের বিপরীতে দাঁড় করানো হচ্ছে একরৈখিক পরিচয় যা হলো খুন একটি লাশ মাত্র।

হতাহতের পরিসংখ্যান বড় না ছোট সেটা বড় কথা নয়- তার সকল মাত্রাগুলো ধরা যাচ্ছে কীনা।  বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে কীনা? কারণ, পরিসংখ্যান  নিজেকে প্রকাশ করে অন্যসব মাত্রা নির্গুণ করে। মানুষ যখন পরিসংখ্যানে পরিণত হয়, তখন তা কল্যাণকর হয়- না এমন বিশ্বাস আমাদের লোকজ চিন্তায় পাওয়া যায়-'গুণতির বছর মড়কি লাগে' অর্থাৎ যে বছর আদম শুমারি হয়, সে বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, প্রাণহানি ঘটে। ইতিহাসে তার নজির রয়েছে। কোনো হতাহতের পরিসংখ্যান দেখতে চাই না।

মানুষে এক অজেয় সত্তা। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তাকে মেরে শেষ করা যাচ্ছে না। মানুষ অমর হয়ে উঠছে। মানুষের সংখ্যা কমছে না বাড়ছে।

বাস্তবতা হলো পরিসংখ্যান হয়ে ওঠার আশঙ্কা মানুষকে তাড়া করে ফিরছে। মৃত্যুর পরিসংখ্যান উৎকণ্ঠা তৈরি করে, ব্যথা জাগায় না। কারণ সংখ্যার কাজ মস্তিস্কে, হৃদয়ে নয়। পরিসংখ্যানে গল্প নেই, নেই জয়-পরাজয়, আবেগ-অনুরাগের অনুরণন। তাই খুনগুলো পড়তে সংখ্যার বাইরে এনে । ভালো খবর হলো, সংবাদপত্রগুলো এমন অনেক একক ঘটনা তুলে ধরছে-ফলে ঘটনার গভীরে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে। যেমন-রংপুরের পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের ঘটনা।

খুনের খতিয়ান বড় হচ্ছে-যা বেদনাদায়ক! রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কবরের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। অরুন্ধতী রায় ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে একটি বক্তৃতা করেন। বিষয় ছিল দ্য মুসলিম গ্রেভিয়াড টক ব্যাক : ফিকশন ইন দ্য টাইম অব ফেক নিউজ। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, কাশ্মীরবাসীর স্বাধিকার আন্দোলন দমনে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী যে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে কাশ্মীরে কবরের বিস্তৃত ঘটেছে ভয়াবহভাবে।

মানুষে এক অজেয় সত্তা। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তাকে মেরে শেষ করা যাচ্ছে না। মানুষ অমর হয়ে উঠছে। মানুষের সংখ্যা কমছে না বাড়ছে। নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠছে মানুষ। নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে। অনায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।  প্রতিরোধে সে সবচেয়ে সুন্দর। হুমায়ুন আজাদ 'গরীবের সৌন্দর্য কবিতায় লিখেছেন-

''জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়...।''

বাঙালির স্বভাবে রয়েছে এক দ্রোহী মনোভাব। যেকোনো নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদী হয়েছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইতিহাস দেখা গেছে জমিদারদের ‍বিরুদ্ধে এ দেশে কৃষক-প্রজা অসংখ্যা বিদ্রোহ করেছে, পরাস্ত করেছে। ফকির সন্নাসিরাও পিছিয়ে ছিল না। পাকবাহিনী পরাজিত করেছে বীরদর্পে। শাসকগোষ্ঠী যখন নিপীড়নের পথ বেছে নেয় তখন বুঝতে তাকে মৃত্যু পিপাসা টানছে। আর মৃত্যু নিষ্ঠুর বলে তার আপন কেউ নেই।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যর্থাথ লিখেছেন, আমাদের ইতিহাস তো শুধু মার খাওয়ার নয়। আমাদের ইতিহাস হিসাব নেওয়ার, আমাদের ইতিহাস প্রতিরোধেরও (প্রথম আলো) 

১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল পুলিশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দেয়। ট্রাকের তলায় পিষ্ট করে হত্যা করে সেলিম ও দেলোয়ারকে। কবি ফরহাদ মজহার এর প্রতিবাদে 'লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক' শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতার শেষের কয়েকটি লাইন হলো-

 মিছিল নিরন্তর সামনের দিকে
সব মিছিল এখন সামনের দিকে
আমাদের সব মিছিল সিধা সাদা সামনের দিকে
…শেষবার সামনাসামনি
ফায়সালা হবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দাবির প্রতি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন বাড়ছে। মানুষ বেরিরে আসছে। প্রতিবাদ ও মিছিলের সারি লম্বা হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে লাল-সবুজের পতাকাজুড়ে। যেকোনো নিপীড়ন বন্ধে সবার দায় রয়েছে। চাই কল্যাণমুখী, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ। খুন চাই না, খুনের হিসাব কষতেও চাই না। চাই সবার জন্য বাংলাদেশ।

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

3h ago