মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে করণীয়
'আমাদের ওখানে এমন সিন্ডিকেট থাকতে পারে যা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।'
—ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ান হাইকমিশনার, ২৯ মে ২০২৪
বাংলাদেশের লুণ্ঠিত অর্থনীতিকে চাঙা করা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনামলে যে দুর্নীতি সর্বব্যাপী বিস্তার করে, তা নির্মূল করার সংকল্প বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ঘোষণা করে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দুর্নীতির একটি অতুলনীয় ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশেই ক্ষমতাশীল একটি মহল সিন্ডিকেট গঠন করে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর তাদের সম্পূর্ণ প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। যার ফলে অভিবাসন ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা সরকারি হারের চেয়ে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
২০২৪ সালের মার্চে মালয়েশিয়ার নতুন সরকার ৩১ মে থেকে দেশটিতে কর্মী গ্রহণ বন্ধের ঘোষণা দেয়। দেশটিতে অভিবাসী কর্মী নিয়োগে দুর্নীতি ও উচ্চ অভিবাসন ব্যয়সহ নানা অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কর্মী চাকরির জন্য নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
সিন্ডিকেটটি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন মালয়েশিয়ান 'দাতো' কর্তৃক, যিনি আইটি কোম্পানি বেস্টিনেটের মালিক। এর সহায়ক সংস্থা ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস) মালয়েশিয়া সরকারের বিদেশি কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থাপনায় অনলাইন সহায়তা দিয়ে থাকে। এফডব্লিউসিএমএস অন্য ১৪টি উৎস দেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য শুধুমাত্র অনলাইন প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে তার নির্ধারিত ভূমিকার অপব্যবহার করে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে এটি বাংলাদেশ থেকে পছন্দমতো নিয়োগকারীদের মাধ্যমে সরাসরি কর্মী নিয়োগের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, যার ফলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
এফডব্লিউসিএমএসের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৬-১৮ এবং ২০২২-২৪ সালে যথাক্রমে দুই লাখ ৬৭ হাজার এবং চার লাখ ৭৬ হাজার, মোট সাত লাখ ৪৩ হাজার বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন। মালয়েশিয়ায় সরকারি নিয়োগ ফি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও বাংলাদেশি কর্মীদের চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয় রিক্রুটিং এজেন্টদের। গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চারজন বিশেষজ্ঞ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে চিঠি দিয়ে উল্লেখ করে যে, জনপ্রতি অভিবাসীকে সাড়ে চার থেকে ছয় হাজার ডলারের মতো ব্যয় করতে হয়েছে।
সূত্রমতে, প্রকৃত খরচের পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই প্রকল্পের মুখপাত্রদের কর্মীপ্রতি এক লাখ ৫২ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে বাধ্য ছিল। অতএব, একটি সংক্ষিপ্ত হিসাব থেকে ধারণা করা যায় যে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে দুই দফা নিয়োগের সময় প্রায় ৯৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যা প্রায় ১১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার (এক মার্কিন ডলার সমান ১২০ টাকা) সমপরিমাণ অর্থ সিন্ডিকেটের সদস্যরা আত্মসাৎ করেছেন।
সূত্র থেকে আরও জানা যায়, বেস্টিনেট তার বাংলাদেশি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করে, যা পরবর্তীতে হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। একই চক্র প্রাক-বহির্গমন মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। এক্ষেত্রেও নিয়োগকারী এজেন্টদের সিন্ডিকেট দ্বারা তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষাগুলো করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ ধরনের চর্চা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকাটিকে অবমূল্যায়িত করে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ট্র্যাক রেকর্ডসহ রিক্রুটিং এজেন্টরা অভিযোগ করে যে, অনেক ক্ষেত্রে এফডব্লিউসিএমএসে তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলো শুধুমাত্র চাহিদাপত্রের (ডিমান্ড লেটার) বিনিময়ে প্রকৃত নিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিল। নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, দাবি বাস্তবায়ন করা এবং শেষ পর্যন্ত কর্মী পাঠানোর মতো বেশিরভাগ নিয়োগের কাজ অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো করলেও, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনেকেই কেবলমাত্র ব্যবসায়িক কাগজপত্র আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করত। এ ধরনের ঘোলাটে পরিকল্পনার অধীনে অভিবাসী পাঠানো ও গ্রহণের দেশে অভিবাসনে প্রকৃত সহায়তাকারীরা সরকারি নথিতে স্থান পায়নি। অন্যদিকে অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় সংস্থাগুলো সহায়ক হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, 'সাব-এজেন্ট' কর্তৃক (তালিকাভুক্ত নয় এমন রিক্রুটিং এজেন্সি) লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে যাতে করে পরবর্তীতে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তাদের দায়ী করা যায়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই একটি গুরুতর অসঙ্গতি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নিয়োগকারী সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকে (বোয়েসেল) যখন প্রাপ্ত চাহিদাপত্রের ছাড়পত্র প্রক্রিয়াকরণে বড় ধরনের বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, তখন সিন্ডিকেটের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়। সংস্থাটি ১০ হাজার চাহিদাপত্রের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশের ছাড়পত্র নিশ্চিত করতে পেরেছিল। কারণ সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো রহস্যজনকভাবে বেসরকারি সংস্থাগুলোতে পাঠানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে (২০২১) সিন্ডিকেট ব্যবস্থার বীজ বপন হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশি নিয়োগকারী সংস্থা নির্বাচনের দায়িত্ব মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এর ফলে সিন্ডিকেটের মূল হোতা 'দাতো' কুয়ালালামপুরে রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার জন্মস্থান বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের পতিত স্বৈরশাসকের একজন শক্তিশালী উপদেষ্টা, সংসদের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য এবং এক প্রবীণ আমলার আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) একজন সাবেক মহাসচিব কর্তৃক সমর্থিত ছিলেন উল্লেখিত এ 'দাতো'।
বলা বাহুল্য, সিন্ডিকেট ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জিত লাখো ডলার এ জুটির লক্ষ্য অর্জনে কাজে এসেছিল। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সম্ভবত একই কারণে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনে সিন্ডিকেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কয়েকটি ক্ষুব্ধ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির দায়ের করা দুটি পৃথক অভিযোগ মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য ২৫টি সংস্থা নির্বাচন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বায়রা সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হলে সংখ্যাটি বাড়িয়ে ১০১ করা হয়। যেহেতু যোগ্যতার জন্য কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি, তাই অনেক নতুন নিয়োগকারী সংস্থাকে লাইসেন্স দিয়ে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এই সুযোগে রাজনৈতিক প্রভাববলয়ের বেশ কয়েকটি নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থা সিন্ডিকেটটির প্রধান সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বর্তমানে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গুজবও ছড়িয়ে পড়েছে যে, সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সমর্থকেরা নতুন ব্যবস্থার ওপর তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রম অভিবাসনের প্রবাহকে তিনবার ব্যাহত করে অভিবাসী কর্মীদের জন্য অপরিমেয় দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে ড. ইউনূস সরকার কর্তৃক অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
কর্তৃপক্ষ নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করতে পারে—
প্রথমত, বাংলাদেশের সমস্ত নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্ট কর্তৃক মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার সমঝোতা স্মারকটির সংশ্লিষ্ট ধারাটির সংশোধন করা। উল্লেখ্য, সিন্ডিকেটের চক্রান্তের কারণে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। অন্যান্য ১৪টি উৎস দেশের কোনো নিয়োগকারী প্রতিনিধি এ ধরনের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়নি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশেই সিন্ডিকেট ব্যবস্থায় জড়িত অপরাধীদের জবাবদিহি করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত জনগণের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রীয় সংস্থার সদস্য ও বাংলাদেশের নিয়োগকারী সংস্থাগুলোসহ প্রধান অপারেটরদের দ্বারা সংঘটিত দুর্নীতি ও জালিয়াতির পুঙ্খানুপুঙ্খ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা এবং মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকেও একই কাজ করার আহ্বান জানানো। তাদের অপরাধ রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক নাশকতার সমতুল্য।
তৃতীয়ত, ভবিষ্যতের নিয়োগসংক্রান্ত উদ্যোগের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে—(ক) নিয়োগ ফি, সরকারি চার্জ, মেডিকেল পরীক্ষা ইত্যাদিসহ সব লেনদেন চেকে হবে এবং কর্মীদের এ ধরনের অর্থ প্রদানের জন্য যথাযথ রসিদ সরবরাহ করতে হবে এবং (খ) কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তালিকাভুক্ত যেকোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হবে।
পরিশেষে, সিন্ডিকেট সদস্যদের জবাবদিহি করতে একটি উপযুক্ত কৌশল তৈরি করার জন্য কর্তৃপক্ষের উচিত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা—যেখানে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, বেকারত্ব, মজুরি প্রদান না করা, শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির মতো বিষয়গুলো নথিভুক্ত হবে।
সি আর আবরার: শিক্ষক, মানবাধিকার এবং দ্য রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) নির্বাহী পরিচালক
Comments