নির্ভীকদের অভিবাদন

স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে পুলিশের ভ্যানের সামনে দাঁড়ানো এক তরুণী। ৩১ জুলাই ২০২৪, হাইকোর্ট এলাকা। ছবি: এমরান হোসেন

মাঠ ছিল উত্তাল, বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলও ছিল অভূতপূর্ব। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাদের চিরাচরিত চাতুরতা অসহায় ছিল বৈষম্যবিরোধী তরুণ নেতৃত্বের কাছে।

বলছি '৩৬ জুলাই' গণঅভ্যুত্থানের কথা।

এই গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র ভিন্ন মাত্রার। বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর যেকোনো দেশের গণঅভ্যুত্থানের চেয়েও ৩৬ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ব্যতিক্রম। কারণ, গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে একটি দানবীয় স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে, যে স্বৈরাচার গণতন্ত্র হত্যা করেছিল, মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল, নিজেকে পরিচিত করেছিল অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। তার কাছে দেশ বা জনগণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতায় থাকা। জনমানুষ ছিল উপেক্ষিত।

ইতিহাসের প্রচলিত ধারণা এমন যে, বাংলাদেশের মানুষকে, বাঙালিকে অধিকার-বঞ্চিত করে খুব বেশিদিন রাখা যায় না। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকার এই ধারণাকে যেন ভুল প্রমাণ করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিপীড়িত মানুষ গভীর অন্ধকার ভেদ করে আলোর রেখার সন্ধান পায়।

প্রতিবাদ ছিল কোটা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও নির্মম দমন-নীতি, মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার কার্ডের ভুল ও অতিব্যবহারে যা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। একজন আবু সাঈদ শহীদ হয়ে সরকারের পতনের পথ উন্মুক্ত করে দেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্টগুলো গবেষণার দাবি রাখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ও হল খালি করার নির্দেশ দিয়ে ভয়-ভীতি ও নির্যাতন শুরু করে সরকার এটা ভেবে স্বস্তিবোধ করছিল যে, আন্দোলন দমন করা গেছে। তখন অসীম সাহস নিয়ে সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 'পানি লাগবে পানি' একজন মুগ্ধ শহীদ হয়ে আন্দোলনের গতি হাজার গুণ বাড়িয়ে দেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে এভাবে গুলির সামনে বুক পেতে দিতে পারে, তা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার কল্পনায়ও ছিল না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' বলার প্রতিবাদে মাঝরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যে মিছিল করেছিল 'তুমি কে আমি কে/রাজাকার রাজার/ কে বলেছে কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার' স্লোগানে, স্বৈরাচারের নখ-দাঁত সে রাতে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল।

শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ছাত্রলীগের পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার পতনের যাত্রা শুরু হয়। পরদিন দখলমুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো।

চূড়ান্ত বিজয়ের আগে পুলিশ যখন ক্যাম্পাসগুলোতে গণগ্রেপ্তার শুরু করল তখন ঢাল হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটক শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাত থেকে মুক্ত করেন তারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেন। পরে শিক্ষক ও পেশাজীবীদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের ঢল নামে শহীদ মিনারের দ্রোহযাত্রায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে।

একজন পুলিশকে স্বৈরাচারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলতে দেখা যায়, 'গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা... একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।' যায় না মানে হচ্ছে একজন আন্দোলনকারী গুলিতে মারা গেলেও পাশে থাকা বাকিরা প্রতিবাদ করে যায়, পালায় না।

এমন সাহসী প্রতিরোধ কে কবে দেখেছে!

এবারের আন্দোলন মানুষ রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল। মানুষ রক্ত দেওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছিল, ছাত্র-জনতার সঙ্গে রিকশাচালক-শ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিয়েছিল। তাদের হত্যা করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, এটা দানবীয় সরকার বুঝতে পারেনি। পরিণতিতে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে দেশ ছাড়তে হয়।

আন্দোলনটির ভিন্নতার আরেকটি উদাহরণ হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দল পেছনে থাকলেও নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যা অভূতপূর্ব-বৈচিত্র্যময়। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সমন্বয়কের সংখ্যা ছিল অজানা। ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হারুন তুলে নেয়। সরকার মনে করে, আন্দোলনের নেতাদের ধরে আনা হয়েছে এবং তাদের মুখ দিয়ে দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে প্রোপাগান্ডা চালালে আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু বাকি সমন্বয়রা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যেভাবে আন্দোলনটি পরিচালিত করেছে, সেটা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।

ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে ৩৬ জুলাই। পৃথিবীতে বহু গণঅভ্যুত্থান-বিপ্লব হবে, যার মধ্যে বারবার ফিরে আসবে বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান। ৩৬ জুলাই বারবার ফিরে আসবে। এই ৩৬ জুলাই যারা সফল করেছে, তাদের মনে রাখতে হবে, স্মরণ করতে হবে। সেই মনে রাখা ও স্মরণ করার অংশ হিসেবেই আমরা এই নির্ভীকদের অভিবাদন জানাচ্ছি।

(ডেইলি স্টার আয়োজিত সাত দিনব্যাপী '৩৬ জুলাই: নির্ভীকদের অভিবাদন' শীর্ষক প্রদর্শনীর ম্যাগাজিন থেকে)

Comments

The Daily Star  | English

Who are Iran’s allies? And would any help if the US joins Israel in its war?

So, as the pressure mounts on Iran, has it been left to fight alone? Or does it have allies that could come to its aid?

16m ago