জনভোগান্তি সৃষ্টি করে ‘জনতার মেয়র’ হওয়া সম্ভব?

আন্দোলনে রাস্তার ব্যারিকেডের ওপর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। ছবি: ইশরাকের ফেসবুক থেকে নেওয়া

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে ইশরাকের মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার আর কোনো বাধা নেই।

এই খবর পাওয়ার পরপরই গতকাল রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ মোড়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, স্লোগান দিয়েছেন- 'এই মুহূর্তে খবর এল, ইশরাক মেয়র হলো', 'এই মাত্র খবর এল, জনগণের বিজয় হলো'।

এর আগে তারা কাকরাইল মোড়, মৎস্য ভবন মোড় ও আশপাশের এলাকায় 'অবস্থান কর্মসূচি' পালন করেন। এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবিও জানান তারা।

বিএনপি ও এনসিপির পৃথক কর্মসূচি হঠাৎ করেই দেশের পটপরিবর্তনের রাজনীতিতে বেশ উত্তাপ তৈরি করেছে। ইশরাককে ডিএসসিসির মেয়র করার দাবিকে সামনে রেখে মাঠে নামে বিএনপি। এরপর নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দেয় এনসিপি। দল দুটির দাবি ভিন্ন ভিন্ন হলেও এটাকে 'ছায়াযুদ্ধ' বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত বুধবার সকাল ১০টা থেকে এই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন ইশরাকের সমর্থকরা, যার সূচনা হয় ১৪ মে। সেদিন থেকে (শুক্রবার বাদে) ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হচ্ছিল। মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের দাবিতে ১৫ মে থেকে নগর ভবনের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে নগর ভবনকেন্দ্রিক সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যায়।

গত বছর সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুন লাগার পর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যালয় নগর ভবনে স্থানান্তর করা হয়। শুধু নাগরিক সেবাই নয়, এই অবরোধ কর্মসূচির ফলে এই মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমেও ভাটা পড়ে।

ভাটা পড়ে ডিএসসিসির মশক নিধনসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মসূচিতেও। এমনকি অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হলেও সরানোর কাজে নামেনি কেউ। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমও চাপা পড়ে আন্দোলনে।

ছবি: স্টার
 

বিএনপির এই আন্দোলন-অবরোধের কারণে তীব্র যানজটের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা, অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভও উগরে দেন ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ। অনেকেই প্রশ্ন রাখেন—এভাবে জনভোগান্তি সৃষ্টি করে 'জনতার মেয়র' হওয়া সম্ভব?

যদিও গতকাল বিকেলে কাকরাইল মোড়ে উপস্থিত হয়ে আগামী ৪৮ ঘণ্টার জন্য আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ইশরাক। পাশাপাশি আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলেও জানান তিনি।

তাদের কর্মসূচির কারণে চরম জনদুর্ভোগ তৈরি হওয়ায় ঢাকার সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, 'সরকার আমাদের অধিকারবঞ্চিত করতে গিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হয়।'

এ পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা—

নির্বাচনী ইশতেহার মানেই 'মিষ্টি কথা কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি'। এমন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ফুটিয়েই ২০২০ সালের মে মাসে ডিএসসিসির দায়িত্ব নিয়েছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস, দায়িত্বে ছিলেন ৫১ মাস। এ সময়ের মধ্যেই তিনি যে প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে ফেলেছিলেন, তার সামান্য উদাহরণ নিচের এই তিনটি প্রতিবেদন- ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে নিয়োগে তাপসের পছন্দই শেষ কথা (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো), তাপসের জন্য দুপুরে ভাত আনতে বরাদ্দ ছিল একটি গাড়ি, জ্বালানি খরচ ২৮ লাখ টাকা (৯ অক্টোবর ২০২৪, প্রথম আলো) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির টাকা 'তাপসের ব্যাংকে' (৯ অক্টোবর ২০২৪, প্রথম আলো)।

তাপস এখন দেশ পলাতক। ইতোমধ্যে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুদক।

তার আগের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনেরও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তার ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
 
ডিএসসিসির 'জনসমর্থনহীন' সাবেক এই দুই মেয়রের ভাগ্য এখন আদালতের হাতে।

'যানজট ও দূষণমুক্ত' বিশ্বমানের বাসযোগ্য এক অত্যাধুনিক ঢাকা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ডিএসসিসি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন সর্বশেষ মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাকও। তবে নির্বাচিত হতে পারেননি। সেই নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক এই সম্পাদক গতকাল বলেছেন, 'আজকে হাইকোর্টের রায় শোনার পর আমাদের দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপাতত আমরা অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত রাখব। আগামী ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হবে তারা কী করে? তাদের যে কর্মকাণ্ড সেটার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কার্যক্রমের নির্দেশনা আসবে।'

সেই কার্যক্রম কী—সড়ক অবরোধ, জনভোগান্তি সৃষ্টি করে আন্দোলন? 

এর আগে এক ফেসবুক পোস্টে ইশরাক লিখেছিলেন, 'ঢাকার রাজনীতির বিষয়ে নতুন উপলব্ধি। এই শহরের রাজনীতির সাথে জড়িত আছে জনগণের আবেগ, স্বনির্ভরতা ও সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা মনোভাব। তারা নিজেদের পছন্দের নেতৃত্ব বা নেতা সম্পূর্ণ নিজেরাই বেছে নেয়।'

বিএনপি নেতারা প্রায়ই বলেন, আওয়ামী লীগের 'আওয়ামী জাহেলিয়াত' শাসনামলে দেশের জনগণ তাদের পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নিতে পারেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী দোসরদের তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রশ্ন হলো—বিএনপি নেতারা কি সত্যিই জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারেন? দেশের পটপরিবর্তনের রাজনীতিতে জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী কাউকে মেয়র হিসেবে মেনে নেবে ঢাকাবাসী? 

আজ শুক্রবার ইশরাক ফেসবুকে লিখেছেন, 'শপথ কেবল একটা ফরমালিটি। জনতার মেয়র হিসাবে আমার দায়িত্ব বর্তায় আগামী কোরবানির ঈদের আগে যাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকে। আমি ঢাকাবাসীকে নিশ্চিত করছি, উত্তরে মেয়র না আসা পর্যন্ত সেখানকার প্রশাসন ও পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করব।'

শপথ নেওয়ার আগেই নিজেকে 'জনতার মেয়র' ভাবতে শুরু করেছেন ইশরাক। ঢাকাবাসীকে 'বর্জ্য ব্যবস্থাপনার' নিশ্চয়তাও প্রদান করছেন। এতে কী প্রতীয়মান হয়?

যেখানে সাঈদ খোকন 'জনতার মেয়র' হয়ে উঠতে পারেননি, তাপস দুর্নীতি ও অনিয়মের পাহাড় মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, সেখানে ইশরাক কি 'বাপকা বেটা' হতে পারবেন, না তার সাম্প্রতিক পূর্বসূরিদের কলঙ্কজনক পদাঙ্ককেই অনুসরণ করবেন?

 

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

Every beat of my patriotic heart, every spark of my nation building energy, every iota of my common sense, every conclusion of my rational thinking compels me to most ardently, passionately and humbly appeal to Prof Yunus not to resign from the position of holding the helm of the nation at this crucial time.

1h ago