‘ফ্যাসিবাদী’ আইকনের পরিসীমা কতটুকু

সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমা থেকে নেওয়া জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম 'আইকনিক' স্লোগান—দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান-খান; লাইনটি দীর্ঘ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা উচ্ছেদে প্রেরণা জুগিয়েছে বহুদিন ধরে, এ নিয়ে হয়েছে পোষ্টার, কার্টুন, দেয়াল চিত্র, ব্যানার।
'হীরক রাজার দেশে' সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই জনতাকে আন্দোলিত করতে সিনেমাটি প্রদর্শনের পাশাপাশি এই স্লোগানটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যবহার করে এসেছেন বহু দিন ধরেই।কাকতালীয় হোক আর অবধারিত হোক, সিনেম্যাটিকভাবেই 'রেজিম' অবসানে লাইনটির স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে বাংলাদেশে, ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে।
জনতার পরম প্রতিরোধে প্রবল পরাক্রমশালী শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটার আগে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে সারা দেশে অসংখ্য ম্যুরাল-ভাস্কর্য-স্থাপনা তৈরি হয়েছে। যার অধিকাংশের নান্দনিকতা ও শিল্পমান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন শুরু থেকেই ছিল। প্রশ্ন ছিল নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়েও।
দীর্ঘ আওয়ামী শাসনামলে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে জনতার সব ক্ষোভ উগড়ে পরে ওইসব ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্থাপনার ওপর। কারণ, সেগুলো যেন হয়ে উঠেছিল হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরম্পরার স্মারক। বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রায় দলীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়ে যাওয়া সংসদ ভবনও জনতার রোষ থেকে রেহাই পায়নি গণঅভ্যুত্থানের প্রথম প্রহরে।
বিভিন্ন স্মারক ভাঙা, নাম পাল্টে দেওয়া নিয়ে জনতার যে বাসনা বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, তাকে অবশ্যই প্রথমত 'চিহ্ন' প্রতিষ্ঠার বাসনা এবং দ্বিতীয়ত 'চিহ্ন' মুছে দেওয়ার বাসনা হিসেবেও পাঠ করতে পারতে হবে। যেমন: 'নৌকা' একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ও চিহ্ন। চিহ্নের দুনিয়ায় নৌকা, শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগ সম-ইমেজ তৈরি করে। অনেকে মনে করেন, নৌকা ও মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আর এনসিপিকে সমার্থক করে ফেলার চলমান সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার মতোই আওয়ামী লীগের এতো বছরের গায়ে ঠেলে ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার রাজনীতির প্রধান বয়ানও ছিল এই যে, মুক্তিযুদ্ধ শুধুই তাদের দলীয় অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের বাকি সব অংশীদারদের শরীকানাকে প্রায় অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান প্রতিষ্ঠার অদম্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধ একটি অনিবার্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষকে কেন্দ্র করেই এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রীভূত বহু বছর ধরে। সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাকি সব অংশীদারকে ইতিহাস থেকে অবলুপ্ত করে, রাষ্ট্রীয় সব কাঠামো ব্যবহার করে একরৈখিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান প্রচারের কারণে মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো স্মারককে আওয়ামী লীগের স্মারক হিসেবেই পাঠ করার মনোজগত পরিপুষ্ট হয়েছে। আর সেটা হয়েছে আওয়ামী আমলের ফ্যাসিবাদী চর্চার কারণে। এই ধারনা শক্তিশালীভাবে এখনো অস্তিত্ত্বমান আছে রাষ্ট্রীক-সামাজিক পরিসরে।
হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে রাষ্ট্রীয় খরচে সবচেয়ে বেশি নির্মিত হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে 'জাতির পিতা' হিসেবে সংবিধানে যুক্ত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। বিগত বছরগুলোতে নির্মিত সিংহভাগ স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেখ পরিবার ও আওয়ামী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে সরকারে বসে থাকা শাসকদল আওয়ামী লীগের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের পর জনতার প্রধান লক্ষ্যই তখন ছিল আওয়ামী লীগ ও হাসিনার নাম-নিশানা মুছে দেওয়া এবং অভ্যুত্থানের পর উন্মত্ত জনতার ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে এসব স্থাপনার ওপর। যদিও, জনতার প্রাথমিক রোষ থিতু হওয়ার পর অভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে অসংখ্য ভাস্কর্য, ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে 'ফ্যাসিবাদের চিহ্ন' আখ্যা দিয়ে, অসংখ্য স্থাপনার নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে 'ফ্যাসিবাদ' মুছে দেওয়ার নাম করে। অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বা শেখ পরিবারের সম্পর্ক না থাকলেও পাল্টে দেওয়া হয়েছে স্থাপনার নাম, ভেঙে ফেলা হয়েছে ভাস্কর্য-ম্যুরাল।
অভ্যুত্থানের ঠিক পরপর ভেঙে ফেলা ময়মনসিংহের শশী লজের 'ভেনাস' ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে জয়দেবপুরে পাক-হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের স্মারক হিসেবে নির্মিত 'জাগ্রত চৌরঙ্গী', শিশু একাডেমীতে স্থাপিত ভাস্কর্য 'দুরন্ত', পলাশীর 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' চত্বর, ভাষা আন্দোলন থেকে ষাটের দশকের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে সারা দেশে নির্মিত অসংখ্য ম্যুরাল ও ভাস্কর্য, ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক হিসেবে স্থাপিত সিধু-কানুর ভাস্কর্য; বেগম রোকেয়াসহ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম পাল্টে ফেলা কীভাবে ফ্যাসিবাদের চিহ্ন মুছে ফেলার অংশ হতে পারে, তা এখনো বোধগম্য নয়।
জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন স্মারক বা চিহ্নকে 'ফ্যাসিবাদী' আখ্যা দিয়ে ভাঙচুর ও নাম পাল্টে দেওয়া জনতার পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পাঠ করা গেলেও, সরকার গঠনের পর থেকে এসব ঘটনাকে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাঠ করার সুযোগ রহিত হয়ে যায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিশাল অংশ জুলাইকে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবেই পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া ব্যক্তি ও সমষ্টিরা জুলুমের অবসান চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন, সক্রিয় হয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। তাই তো হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ওপর যে আক্রোশ, সেটা মুক্তিযুদ্ধের স্মারকের ওপরে পর্যবসিত হতে দেখে প্রচুর মানুষ ইতোমধ্যে নাখোশ হতে শুরু করেছেন। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ঘটা সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ এবং সিধু-কানুর ব্রিটিশবিরোধী লড়াই অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসেই প্রতিরোধ স্পর্ধার অন্যতম বড় দৃষ্টান্ত। হাসিনার জুলুমের বিরুদ্ধে জুলাই যেমন আমাদের জলজ্যান্ত প্রতিরোধের ঘটনা, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ ও সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসও প্রতিরোধের ইতিহাস। জুলাইয়ের শহীদরা আমাদের প্রতিরোধের সাক্ষ্য; ব্রিটিশবিরোধী লড়াই, মুক্তিযুদ্ধও আমাদের প্রতিরোধের সাক্ষ্য। অবচেতনে বয়ে যাওয়া এসব চিহ্নের ওপর আক্রমণকে বহমান চেতনার ওপর আঘাত হিসেবেও পাঠ করছেন অভ্যুত্থানের অংশীদের অনেকেই।
হীরক রাজার বিশাল 'আইকন' বা প্রতিরূপকে ধরাশায়ী করে রাজার কর্তৃত্বকে খানখান করে রাজ্যের প্রজারা হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন। রাজার কর্তৃত্বের স্মারক বা চিহ্নকে অপসারণ ও প্রজাদের প্রস্ফুটিত স্বাধীন সত্ত্বার দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে সত্যজিত রায়ের সিনেমা শেষ হলেও অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কার, পুনর্গঠন, নতুন বন্দোবস্ত তথা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের লক্ষে ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া জনগণের রাজনৈতিক কর্তৃস্বত্ত্বা নিয়মিতভাবেই জাগরূক হতে দেখা যাচ্ছে।
নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে জনগণের কর্তৃস্বত্ত্বা জেগে থাকা আশা জাগানিয়া ঘটনা হলেও বিগত এক বছরে অনেকগুলো চিহ্ন বা স্মারক গুড়িয়ে দেওয়া, নাম পাল্টে দেওয়ার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কোনগুলো ফ্যাসিবাদী আইকন আর কোনগুলো ফ্যাসিবাদী আইকন না, তার পূনর্মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি।
ফ্যাসিবাদ তথা আওয়ামী লীগের চিহ্ন মুছে ফেলার নাম করে এ ভূখণ্ডের জাতীয় জীবনের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধের বা ব্যক্তিত্বের স্মারক বা চিহ্ন গুড়িয়ে দেওয়া, ভেঙে ফেলা, নাম পরিবর্তন বিষয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য না থাকায় বহুদিন থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, চিহ্ন মুছে দেওয়ার 'বাসনা'র পালে ক্ষমতার হাওয়া কাজ করছে কিনা। ভাঙচুর ও নাম পাল্টানোর বাসনাকে কতদূর বিস্তৃত হতে দেওয়া যাবে, সেই সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে কার্যকরী না হওয়ার কারণে এই সরকারের সদিচ্ছা অথবা অক্ষমতার দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধের স্মারক ও চিহ্ন মুছে ফেলার বাসনাকে আস্কারা দেওয়ার ন্যারেটিভ আরও জেঁকে বসে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতাকেই গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নজীর আমিন চৌধুরী জয়: সাবেক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
Comments