‘আদর্শ উইকেটের’ বাস্তবতাও টের পেল বাংলাদেশ

উড়তে থাকা বাংলাদেশের ওয়ানডে দলকে জোর ধাক্কায় মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে। বুঝিয়ে দিল কোন বাস্তবতায় আসলে দাঁড়িয়ে তামিম ইকবালের দল।

টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে ধুঁকতে থাকলেও অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলটা যেন উড়ছিল। টানা জয়ে ওয়ানডে সুপার লিগেরও শীর্ষে উঠে গিয়েছিল। উড়তে থাকা বাংলাদেশের ওয়ানডে দলকে জোর ধাক্কায় মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে। বুঝিয়ে দিল কোন বাস্তবতায় আসলে দাঁড়িয়ে তামিম ইকবালের দল।

টি-টোয়েন্টিতে যাই হোক, ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের কাছে হারবে- এমন ভাবনা কারোরই ছিল না বোধহয়। এই সিরিজের আগে টানা ১৯ ম্যাচ জিম্বাবুয়ে হেরেছে বাংলাদেশের কাছে। এই সিরিজ তারা খেলতে নেমেছে শন উইলিয়ামস, ক্রেইগ আরভিন, ব্লেসিং মুজারাবানি, টেন্ডাই চাতারাকে ছাড়া। খেলতে নেমে হারিয়েছে রায়ান বার্লকেও।

সেরা একাদশের পাঁচজন নেই। বোলিংয়ে প্রায় কিছুই নেই, ব্যাটিংয়ে ছিলেন কেবল সিকান্দার রাজা। তিনি পাশে পেয়ে গেলেন ইনোসেন্ট কাইয়া আর রেজিস চাকাভাকে। ব্যস হয়ে গেল।

অনেক না থাকার মাঝে জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে বড় যেটা ছিল সেটা আবার ছিল না বাংলাদেশের। ভাল উইকেটে খেলার আদর্শ অ্যাপ্রোচ। বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের দিক থেকে যেখানে পড়েছিল সাবেকি ঘরানায় সেখানে জিম্বাবুয়ে বুঝিয়ে দিল, ৫০ ওভারের ক্রিকেটের আগের দিন আর নাই।

ব্যাটিংয়ে ঘাটতি

ওয়ানডে সুপার লিগে বাংলাদেশ যতগুলো জয় পেয়েছে তার প্রায় সবই ছিল মন্থর উইকেটে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐতিহাসিক জয়ের সিরিজেও দুই ম্যাচ ছিল তুলনামূলক মন্থর উইকেটের সেঞ্চুরিয়নে। যেখানে বল গ্রিপ করায় বোলারদের পাওয়া গেছে ঝাঁজালো অবস্থায়। বোলাররা মূল কাজ করে দেওয়ায় ব্যাটিং নিয়ে ভাবতে হয়নি। বাংলাদেশ যেন মন্থর উইকেটের দল। সেটা বোলিং-ব্যাটিং দুই বিভাগেই। উইকেটে বল গ্রিপ করলে বোলাররা যেমন সুবিধা পান, ব্যাটসম্যানরাও তাতে ধাতস্থ। তাদের সীমানায় যে তিনশো রানই এখনো বিশাল বড় স্কোর।

প্রথম ওয়ানডেতে টসের সময় অধিনায়ক তামিম বলছিলেন, ২৭০ রানের পুঁজির দিকে গেলে খেলা জিততে পারবেন তারা। সেই ম্যাচে তারা আরও ৩৩ রান বেশি অর্থাৎ ৩০৩ রান করেছিলেন। কিন্তু ম্যাচ হেরেছেন ১০ বল আগে, ৫ উইকেটে। শুরুর এই চিন্তা প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ উইকেট অনুযায়ী পুঁজির হিসাব নিকাশটাতে গড়বড় করেছে।

সেই হিসাব নিকাশের তাল দেখা গেছে ব্যাটিং অ্যাপ্রোচে। নিরাপদ পথে হেঁটেছে দল। কয়েকজনের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য-জনক হলেও পরে দেখা গেছে দল আসলে পায়নি নিরাপদ ঠিকানা। ৬২ রানে ৩ উইকেট পড়ার পরও পালটা আক্রমণ চালিয়ে ম্যারাথন জুটিতে সিকান্দার-কাইয়া চলে যান উৎসবের মঞ্চে।

ওই ম্যাচের দুটো ফেইজ বাংলাদেশের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। বাংলাদেশের দুই ওপেনারই (লিটন-তামিম) শুরু আনেন মন্থর। লিটন পরে পুষিয়ে দিলেও তামিম পারেননি। তিনি ফেরেন ৮৮ বলে ৬২ করে। নিজের ফিফটির কাছে গিয়ে তামিমের ইনিংস হয়ে গিয়েছিল বেশ মন্থর। ৪৪ থেকে ৫০ এই ৬ রানের জন্য তার লেগেছে ২২ বল! ফিফটি করেন ৭৯ বলে। লিটন ৭৫ বলে ফিফটি করেও পরে ১৪ বলে তুলেন আরও ৩১। ৮৯ বলে ৮১ করে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট থামায় থাকে। লিটন চোটে না পড়লে হয়ত ৩৩০ রানের ঠিকানায় যেতে পারত বাংলাদেশ। এই ম্যাচের শেষ দিকে উইকেট হাতে রেখেও স্লগ করতে পারেননি মুশফিকুর রহিম। তার ফিফটিও স্লগ ওভারের পরিস্থিতির দাবির সঙ্গে ছিল না মাননসই।

দ্বিতীয় ম্যাচে খোলস বদলে তামিম ছিলেন আগ্রাসী। ৪৩ বলেই করেন ফিফটি। পঞ্চাশেই থামেন ৪৫ বলে। তার সৌজন্যে পাওয়া শুরুতে পরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর মাহমুদউল্লাহর। কিন্তু তার ইনিংসটাই (৮৪ বলে ৮০) যেন ছিল কাল। এক পর্যায়ে তিনি ২৭ রান করতে খেলেন ৫০ বল। সেটা পরে কিছুটা পুষাতে পারলেও যে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল দল পরে আর সেখানে ফেরা যায়নি। মাঝের ওভারে তার অনেকগুলো ডটবল সাড়ে ছয়ের উপরে থাকা রানরেটকে নামিয়ে দিয়েছিল পাঁচের নিচে।

ম্যাচ শেষে কোচ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন দুই ম্যাচেই কুড়ি-পঁচিশ রানের ঘাটতি ছিল। আসলে ঘাটটি ছিল আরও বেশি। জিম্বাবুয়ের টপ অর্ডার ভালো করলে বাংলাদেশ এমনকি কোন ফেজেই লড়াই জমাতে পারত না। বাংলাদেশের ছয়ে মাহমুদউল্লাহ অনেকটা পুষিয়ে দেওয়ার পরও যেখানে ৮৪  বলে করেছেন ৮০, জিম্বাবুয়ের ছয়ে নামা চাকাভা ৭৩ বলেই করে ফেলেন সেঞ্চুরি। ঘাটতিটা এখানে স্পষ্ট। চাকাভা বরং ব্যাট করেছেন আরও কঠিন বিপদের মাঝে। 

দেড় বছর পর ভারতে হতে যাওয়া ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের বেশিরভাগ উইকেটই থাকবে রান প্রসবা। সেখানে চিন্তার সীমানা সাড়ে তিনশোয় নিয়ে যেতে না পারলে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বাংলাদেশকে। 

দিশেহারা বোলিং

ব্যাটিংয়ের মতো বাংলাদেশের বোলিংটাও পিচের আচরণ নির্ভর। বাংলাদেশের পেসাররাও অনেকটা কাটার নির্ভর সাফল্য পেয়ে আসছিল। উইকেটে বল একটু গ্রিপ করলে তাদের কাটার-স্লোয়ার ধারালো হয়। কিন্তু তেমন সহায়তা না থাকলে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না তারা। মোস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদদের কোন রকম হুমকি মনে হয়নি গোটা সিরিজে।

দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ গতির সঙ্গে স্যুইং মিলিয়ে হাসান মাহমুদ হুমকি হয়েছিলেন প্রতিপক্ষের জন্য। কিন্তু বল পুরনো হতে তার ধারও কমে যায়। স্পিনাররা এসব উইকেটে যে জিম্বাবুয়ের মতো প্রতিপক্ষের জন্যও হুমকি না সেটা প্রমাণিত। ফলাফল উপায়হীনভাবে অধিনায়কের নখ কামড়ানো।

বেহাল ফিল্ডিং

ফিল্ডিং বাংলাদেশের অনেক দিনের সমস্যা। ক্যাচিং তো বটেই, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে নেই কোন তেজ। বাংলাদেশের একাদশে অন্তত ৪-৫ জনকে প্রতিদিন ফিল্ডিংয়ে লুকাতে হয়। প্রথম ম্যাচে একটি দৃশ্যের বর্ণনা করা যাক- রাজার মারা ড্রাইভ হালকা গতিতে লং অফ ধরে ছুটছিল, অধিনায়ক তামিম পিছু ছুটেও নাগাল পেলেন না, বাউন্ডারির কাছে গিয়ে ডাইভ দিলে অন্তত এক রান বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তার শরীর বোধহয় সেই রিফ্লেক্স দেখাতে পারেনি। এসব ঘাটতি পোষানোর বদলে তরুণদের মধ্যে আফিফ হোসেনও সমানে ফাম্পল করে গেছেন। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, এনামুল হক বিজয়দের হাতে রেখে এক রানের জায়গায় দুই রান বেরিয়েছে।

মন্থর উইকেটে খেললে ফিল্ডিংয়ের এসব ঘাটটিও টের পাওয়া যায় না অনেক সময়। আদর্শ উইকেট মেলে ধরল এই বাস্তবতাও।

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

1h ago