‘ইগোর’ আগুনে পুড়ছে সিলেটের ক্রিকেট
'সমাধান আবার কি? লিগ তো খুব সুন্দরভাবে হয়েছে, একেক ম্যাচে তিনশোর বেশি রান হলো।' মূল খেলোয়াড়দের ছাড়া একাডেমির কিশোরদের নিয়ে প্রথম বিভাগ লিগ আয়োজন নিয়ে এমন মন্তব্য সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহিউদ্দিন আহমেদ সেলিমের। ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনামুল হক জুনিয়র বলছেন, 'ইগো নিয়ে যদি সবাই থাকি তাহলে সিলেটের ক্ষতি।'
সংকটের শুরু গত ফেব্রুয়ারি মাসে। রেলিগেশন ছাড়া প্রথম বিভাগ লিগ দেওয়া হলে আন্দোলনে নামেন সিলেটের শীর্ষ ক্রিকেটাররা। সব রকমের ক্রিকেট বর্জন করে ফেলেন তারা, চলে মানববন্ধন, অনশনের মতন কর্মসুচি। এরপরই সংগঠক ও খেলোয়াড়দের মধ্যে তৈরি হয় চরম সংকট।
খেলোয়াড়রা যেহেতু আন্দোলন করছেন তাদের পাত্তা না দিয়ে একাডেমির খেলোয়াড়দের নিয়েই শুরু করে দেওয়া হয় লিগ। আয়ারল্যান্ড সিরিজের জন্য বিরতি পড়া লিগ প্রায় শেষ ধাপে। একাডেমির কিশোরদের নিয়ে লিগ আয়োজন নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্রিকেটার বলছিলেন, 'শুনেছি উল্টো টাকা দিয়েও খেলেছে কিছু খেলোয়াড়।'
মাহিউদ্দিন সুন্দরভাবে লিগ আয়োজন হয়েছে বললেও, কার্যত জৌলুস খুব একটা কিছু ছিল না। খেলার মানে নিশ্চিতভাবেই পড়েছে বিশাল প্রভাব। যা টের পেয়েছে সিলেট জেলা ক্রিকেট দল। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে গত আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সিলেট। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গিয়ে এবার ভয়াবহ বিপর্যয় হয়েছে দলটির। প্রথম স্তর থেকে নেমে গেছে দ্বিতীয় স্তরে।
আচমকা এই পতনের কারণও চলমান আন্দোলন। মূল খেলোয়াড়রাই যে কেউ ছিলেন না। দল করা হয়েছে লিগে খেলা ওই একাডেমির নতুনদের নিয়ে। এই বিপর্যয়ের দায়ভার ক্রিকেটারদেরই দিলেন মাহিউদ্দিন, 'এর দায়ভার ওদের। ওরা খেলেনি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে জেলা দলে। ওরা চিঠি দিয়েছে আমাদের যে তারা খেলবে না। মৌখিকভাবেও বলেছে খেলবে না। তারা চিঠির মাঝে লিখেছে কোন খেলা খেলবে না।'
তবে সিলেট ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান তাজিন আবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কয়েকজনকে দলে রাখার অনুরোধ পর্যন্ত করেছিলেন তারা, 'আমরা বলেছিলাম যারা সিলেটের আগামীর তারকা হবে, তাদেরকে রাখেন। যারা গতবারও দলে ছিল। তাদেরকে তারা রাখেননি, এমনকি অন্য জেলা দলে খেলার ছাড়পত্রও দেননি। কারণ এসব খেলোয়াড়দের তো ক্যারিয়ার আছে। আপনি না নিলে অন্য দলে তো খেলতে পারত।'
'তারা মনে হয়েছে আমাদেরকে প্রতিশোধ নিয়েছেন। মনে হয়েছে তারা আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন।'
গতবার খেলা সফর আলি, আসাদুল্লাহ গালিব, ফেরদৌসরা এবারও খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলনকারী এসব ক্রিকেটারদের কথা আর কানে নেওয়া হয়নি। যদিও এই ব্যাপার জানা নেই বলে দায় এড়ান মাহিউদ্দিন, 'আমি এটা জানি না। আমি দেশের বাইরে ছিলাম, এটা আমার জানা নেই।'
দুই পক্ষের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে আসলে সমাধান কি? জাতীয় দলের সাবেক তারকা এনামুল হক জুনিয়র তাকিয়ে আছেন বিসিবি পরিচালক শফিউল আলম নাদেলের দিকে, 'আমরা আর কাঁদা ছোঁড়াছুড়িতে নাই। তারা যদি ভালোভাবে লিগ দেন তাহলে আমরা আগামীতে খেলতে রাজী আছি। একটা শুধু কষ্ট আছে জেলা দল নিয়ে। আমরা অনুরোধ করেছিলাম, খেলোয়াড়দের জেলা দলে নেন। তারা নেননি। জেলা দলও খুব খারাপ ফল করেছে। কোচ পর্যন্ত খেলতে নেমছিলেন।'
'নাদেল ভাই আশ্বাস দিয়েছেন বসার। এরপর সবাই তো ব্যস্ত হয়ে গেল। আয়ারল্যান্ড সিরিজও চলে আসল। এরপর আশা করি বসা হবে।'
লিগ ও জেলা দলে খেলতে না পারা ক্রিকেটাররা অবশ্য বসে নেই। সিলেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বৃহস্পতিবার থেকে রাগীব আলির মাঠে শুরু হচ্ছে একটি টুর্নামেন্ট। এনামুল ও তানিজের মতে এটা, 'খেলোয়াড়দের মাঠে রাখা ও ঈদের আগে তাদের একটু অর্থনৈতিক সুবিধা করে দেওয়ার জন্য করছি।'
পরের বছর রেলিগেশন থাকছে কি?
'আমি সব সময় রেলিগেশনের পক্ষে। আমার মেয়াদে মাত্র একবার রেলিগেশন ছাড়া লিগ হয়েছে।' মাহিউদ্দিন সেলিমের জোর দাবি। এরপর এবার রেলিগেশন রাখতে না পারায় দায় দিলেন মাঠ সংকট আর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের উপর, 'এখানে ক্লাবগুলোরও ব্যাপার। ক্লাবগুলো মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার রেলিগেশন থাকবে না। আমার তো কমিটি আছে। আমি তো কমিটির বাইরে যেতে পারি না। আমি একা সিদ্ধান্ত নেইনি। কমিটির সঙ্গে ১০টি ক্লাব জড়িত। সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
মজার কথা হলো, ক্লাবগুলোর মধ্যে দুটির আবার সরাসরি মালিকানা মাহিউদ্দিনের নিজেরই। স্থানীয় পর্যায়ে গুঞ্জন আছে আরও তিন-চারটা ক্লাবও তারই নিয়ন্ত্রণে।
সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে শুরু হয় সিলেটের লিগ। তখন আবহাওয়ায় থাকে অনুকূলে। তখন খেলা না হওয়ায় মূলত তৈরি হয়েছে মাঠ সংকট। এনামুল জুনিয়রের মতে নির্দিষ্ট একটা ক্যালেন্ডার থাকলে কোন সমস্যাই হতো না, 'ভরা মৌসুমে খেলা হয়নি। তখন মাঠ ফাঁকা ছিল। সঠিক সময়ে লিগ শুরু হলে সব কিছুই হয়। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি সবই হয় যদি নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকে।'
এবার ওই সময়টায় লিগ শুরু করতে না পারার ভিন্ন এক কারণ জানান মাহিউদ্দিন, 'গতবার দ্বিতীয় বিভাগ রমজানে দিয়েছিলাম। রমজানে কেউ খেলতে রাজী হয়নি। রমজানের পর বৃষ্টি শুরু হলো, সেই বৃষ্টি আর সেপ্টেম্বরে গিয়ে থেমেছে। ওই দ্বিতীয় বিভাগ আগে দিতে গিয়ে আমাদের দেরি হয়েছে। কারণ একটা দল উঠবে, আরেকটা নামবে। এজন্য একটু সমস্যা হয়েছে। এইগুলো বুঝতে হবে না তাদের?'
আগামী বছর আলোচনার ভিত্তিতে রেলিগেশনসহ লিগ আয়োজন হবে কিনা এমন প্রশ্নে আশাবাদের কথা বললেও ক্রিকেটারদের উপর রাগ আড়াল করতে পারেননি মাহিউদ্দিন, 'আমি আশাবাদী। পরেরবার হবে। এবার বললাম তো মাঠ সংকটের কারণে দ্বিতীয় বিভাগ আগে করতে হয়েছে।'
'আমি যেহেতু জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। আমার কাছে সবার দরজা খোলা। আমার কাছে বিচার দিবে আর অনুলিপি দিবেন সবার কাছে। এটা তো হয় না। ইগো নিয়ে চলে না বুঝেছেন।'
Comments