অপ্রতিরোধ্য মারুফা – সৈয়দপুর থেকে মিরপুর

Marufa Akter

সৈয়দপুরের প্রত্যন্ত এক এলাকা ঢেলাপীর। সেই ঢেলাপীর থেকে ক্রিকেটার মারুফার রাজধানী শহর ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ওঠে আসার গল্পটা রূপকথাকেও যেন হার মানায়। গল্প বা সিনেমায় মানুষের জীবনের গল্প ওঠে আসে। কিন্তু জীবন কখনো গল্প বা সিনেমারও অধিক। মারুফার জীবনও তাই।

দারিদ্র্যের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া বর্গা চাষি পিতা আইমুল্লাহর পরিবারে ও রক্ষণশীল একটি সমাজে জন্ম নেওয়া একটি মেয়ের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আপাত দৃষ্টিতে অবাস্তবই মনে হয়। কিন্তু স্বপ্ন যখন দুর্বার তখন তাকে রুধে সাধ্য কার? মারুফার জীবনের বিজয়গাঁথাও যেন এখানে। হার না মানা, হাল না ছাড়া। অকপটে বলেছেন, পিতার সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজ আমাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছে।

১৬ জুলাই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের নারী ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে প্রথম জয়ের অন্যতম কারিগর মারুফা। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ঐতিহাসিক ফাইনালের পর ভারতকে আবার হারাল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের তৃতীয় জয়। বিজয়ের কৃতিত্ব অষ্টাদশী কিশোরী মারুফাকে না দিলেই নয়।

বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ৪০ রানের জয়ে ৪ উইকেট নেন মারুফা। তার সঙ্গী রাবেয়া নেন ৩ উইকেট। এভাবেই বিজয়ের পথ রচনা করেন। অথচ এই মারুফা বিকেএসপিতে ২০১৮-১৯ সেশনে ভর্তির জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড় হলেও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারেননি। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ হলে এগিয়ে আসে বিসিবি।

রত্ন চিনতে ভুল করেনি প্রতিষ্ঠানটি। মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের মুকুটও উঠেছিল তার মাথায়। তখন সে কেবল দশম শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ে। পরে মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জন্য ঘোষিত ১৫ জনের দলেও ডাক পান মারুফা আক্তার।

ষাটের দশকেও পুরান ঢাকায় যে নারীরা ঘর থেকে বের হতে হলে রিকশার চারদিকে পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী থাকতে হতো সেখানে আজকের বাংলাদেশে মারুফা অবরোধবাসিনীদের ঘেরাটোপ ভেঙে চিতার বেগে দৌড়ে মাঠে বল করছেন এই সাহসই মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে নারীদের অর্জন। কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো সামাজিক রীতি নীতি বা প্রথার দোহাই দিয়ে নারীদের যুগ যুগ ধরে ঘরবন্দি করে রাখা হয়েছে।

বাংলায় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তাঁর লেখায় বলেছিলেন, 'যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।'

প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মারুফারা তাই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার, আগল ভাঙার দারুণ প্রতীক। প্রেরণারও অনিঃশেষ উৎস। এদেশে কর্মক্ষেত্রেও নারীদের জয়জয়কার - প্রশাসনে, শিক্ষকতায়, ব্যাংকে, এনজিওতে। আমাদের বিশাল পোশাকশিল্পে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সামাজিক স্টিগমাকে পরোয়া না করে বেরিয়ে আসা বস্ত্রবালিকারা এদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও আমাদের অর্জন দেশের সীমানা পেরিয়ে মারুফাদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে যাক।

চিতার বেগে ছুটছো তুমি ছুটছে তোমার পা

আগুন হয়ে জ্বলতে থাকো ভগিনী মারুফা।

Comments

The Daily Star  | English
remittance earning of Bangladesh

Remittance jumps 32% in May

Migrants sent home $2.97 billion last month

40m ago