রুট কি বাজবলের দর্শন থেকে সরে দাঁড়ালেন?

রুট আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি কেন বিশ্বসেরাদের একজন। যিনি আপনাকে রিভার্স স্কুপে বিনোদন দেবেন, আবার ইস্পাত-দৃঢ় রক্ষণে দলের বিপদও তাড়িয়ে দিবেন।
ছবি: এএফপি

কখন আসতে যাচ্ছে জো রুটের রিভার্স স্কুপ?

যে শটের কারণে সাম্প্রতিককালে তর্কসাপেক্ষে ইংল্যান্ডের ইতিহাস সেরা ব্যাটসম্যানকে বিদ্ধ হতে হয়েছে সমালোচনার তীরে, ভারত-ইংল্যান্ড চলমান সিরিজের তৃতীয় টেস্টে জাসপ্রিত বুমরাহকে সেই শট মারতে গিয়ে আউট হওয়ায়, শটটাকে তো ইংল্যান্ডের গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ খেতাব দিয়েই ফেলে- ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে শট হিসেবে।

চতুর্থ টেস্টের প্রথম ইনিংসে রুটের ব্যাটিংয়ের সময় তাই শুরুতে করা প্রশ্নটা সঙ্গে করেই খেলা দেখেছেন হয়তো আপনি। রাঁচি টেস্টে অবশ্য ২৭৪ বলের ইনিংস খেলেছেন রুট, সেঞ্চুরি করে থেকেছেন অপরাজিত। এর মধ্যে একটি বলেও খেলতে যাননি রিভার্স স্কুপ।

রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাদেজা বোলিং করে যাচ্ছেন। লেগ সাইডে সব ফিল্ডার সার্কেলের ভেতরেই রাখলেন রোহিত শর্মা। সুইপ খেলো, ভারত প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছে। বাজবল যুগে রুটের ব্যাটিংয়ের অনুসারী যদি হয়ে থাকেন, নিশ্চিতভাবেই আপনি জানেন, রুট খেলতে যাবেন সুইপ। এমনিতেও ভারতে তার সাফল্যের বড় অবদান এই সুইপে দক্ষতাই। রুট পঞ্চাশ পূর্ণ করে ফেললেন। একটিবারও সুইপ খেলতে যাননি। ১১৫তম বলে গিয়ে এরপর প্রথমবারের মতো খেললেন সুইপ। ২৭৪ বলের ইনিংসে আর মাত্র যে একটি সুইপ খেলেন, সেটি একেবারে গিয়ে ২৭২তম বলে। 

রুট ক্রিজে থিতু হয়ে যাওয়ার পর অশ্বিন লেগ সাইডে ফিল্ডার বাউন্ডারিতে রেখেছিলেন দুজন। কিন্তু রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে নিয়মিত বল করার সময় অফ সাইডে সবাইকে রেখেছিলেন সার্কেলে। জাদেজাও একইভাবে স্লিপের সাথে রেখেছিলেন পয়েন্ট৷ রিভার্স সুইপ খেলার মোক্ষম সুযোগ। রিভার্স সুইপে সিদ্ধহস্ত রুট তবু পুরো ইনিংসে শটটা খেলতে গেলেন মাত্র একবার৷ অথচ বাজবলের আগ্রাসী ক্রিকেটের মন্ত্র জপে যখন ব্যাটিং করে গেছেন রুট, তখন এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেন কী, উল্টো তো ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলতেও পিছপা হননি একটুও। তাহলে কি বাজবলের দর্শন থেকে সরে দাঁড়ালেন রুট?

রুট যে মাপের ক্রিকেটার, বাজবলের আগ্রাসী ব্র‍্যান্ডের ক্রিকেট খেলার প্রয়োজনীয়তা তার কতটুকু, সেটি শুরু থেকেই বিতর্কের জায়গা ছিল। তৃতীয় টেস্টের আউটটি তা আবার উসকে দিয়েছে। ২ উইকেটে ২০৭ রান নিয়ে রাজকোট টেস্টের তৃতীয় দিনে খেলতে নেমেছিল ইংল্যান্ড। সেখানে দিনের শুরুতেই রিভার্স স্কুপ খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে নিজের মরণ ডেকে আনেন রুট। এরপর ইংল্যান্ড ৯৫ রানেই হারিয়ে ফেলে বাকিসব উইকেট। ধসের শুরুটা তাকে দিয়েই হলো বলে হয়তো সমালোচনার আয়নায় তার চেহারাটাই ভেসে উঠে বেশি করে! 

এরকমই আরও একবার রিভার্স স্কুপে আউট হয়েছিলেন রুট। ২০২৩ সালে সেই আউটের পরের টেস্টে খেলতে নামেন ওয়েলিংটনে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাঁকান ১৯২ বলে সেঞ্চুরি। রাঁচিতে রুট খেললেন আরও ধীরগতিতে। সেঞ্চুরি এলো ২০৯ বলে। বাজবলের ব্যাটিং লাইনআপে আগ্রাসী ক্রিকেটে সবচেয়ে বেমানান বেন ফোকসেরও যে সেঞ্চুরিটা আছে, তাতেও লেগেছে এর চেয়ে কম বল। সেখানে রুট কিনা খেললেন বাজবল-যুগের সবচেয়ে ধীরগতির সেঞ্চুরি। বাজবল যুগে আশির উপরে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা রুটের ১২২ রানের ইনিংসে স্ট্রাইক রেট গেল না ৪৪.৫৩ এর উপরেই। 

এটাও কিন্তু বাজবল। হ্যাঁ, ভ্রু কপালে উঠে গেছে হয়তো আপনার। বাজবলের মানে তো আগ্রাসী ক্রিকেট। ডিকশনারিতেও শব্দটার মানে উঠে গেছে তাই। আপনিও হয়তো জানেন সেটাই। কিন্তু আদতে বাজবল মানে কী? উইজডেন অ্যালম্যানাকের সম্পাদক লরেন্স বুথ ও দ্য টেলিগ্রাফের সাংবাদিক নিক হোল্ট একটা বই লিখেছিলেন- বাজবল: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব অ্যা টেস্ট ক্রিকেট রেভোল্যুশন।

বইটায় ইংল্যান্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রব কি জানান ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সাথে তার কোচ নিয়োগের ইন্টারভিউয়ের কথা। যেখানে ম্যাককালাম ব্যাটিং নিয়ে বলেন, সবসময় বোলারের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা থাকবে, সময় বুঝে চাপ শুষে নিতেও হবে। গত অ্যাশেজের সময়ে বেন স্টোকস সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তারা দলের সবাইকে সবসময় আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের কথা বলেন না। ব্যাটার পরিস্থিতি দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে, সে ওই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কীভাবে খেলার জন্য উপযুক্ত, সে স্বাধীনতাটুকু দেওয়া আছে। রাঁচিতে ১১২ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলা ইংল্যান্ডকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন রুট?

ক্রিকেট এমন খেলা যেখানে কন্ডিশনকে সম্মান না জানিয়ে উপায় নেই। বাজবলকে আগ্রাসী ক্রিকেটের চাদরে শুধু জড়িয়ে নিলেই হচ্ছে না। সময়মতো চাপ শুষে নিতে রক্ষণে মনোযোগ না দিলে নির্বোধের দলেই ফেলা হবে যেকোন দলকে। রুটও কন্ডিশনকে সম্মান জানিয়ে খেলেছেন সেই তালে। সকালের সেশনে ভালোই সিম মুভমেন্ট পেয়েছিলেন ভারতের পেসাররা। টার্ন খুব বেশি পাননি স্পিনাররা, তবে বাউন্স ছিল একেবারেই নিচু। এমন লো-বাউন্সের উইকেটে সুইপ-রিভার্স সুইপ নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ হতো খুব বেশি। রুট সে কারণেই ওই পথে বলতে গেলে পা বাড়াননি। আগের ম্যাচে সুইপ খেলতে গিয়ে আউট হওয়াটাও মনে থাকবে হয়তো৷ রাঁচির সেঞ্চুরি যেমন গড়ে উঠেছে সুইপে বাউন্ডারি ছাড়াই, উপমহাদেশে রুটের অন্য সেঞ্চুরি আছে সুইপে ভর করেই। 

রুট 'বাজবল' থেকে সরে যাননি। তবে বাজবলীয় 'বিনোদন' থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। বেন স্টোকস অনেকবারই বলেছেন, তারা সাদা পোষাকের খেলাটায় বিনোদন দিতে চান। রুটও সেই বিনোদনের অংশ হয়েছিলেন দারুণভাবে। বাজবলের রুট বললে নিশ্চয়ই মনে পড়বে- রিভার্স স্কুপ। রুটের মতো ক্রিকেট ব্যাকরণের পূজারী একজনকেও যে বাজবল রিভার্স স্কুপের মতো শট খেলিয়ে ফেলে। রুটের এই স্কুপও তো বিনোদনেরই অংশ। অধিকাংশ লোকই তা উপভোগ করার কথা বলবেন। রুটের ২৭৪ বলে ১২২ রানের ইনিংসে সেই বিনোদনের উপস্থিতি ছিল না ঠিক।  

তবে রুট আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি কেন বিশ্বসেরাদের একজন। যিনি আপনাকে রিভার্স স্কুপে বিনোদন দেবেন, আবার ইস্পাত-দৃঢ় রক্ষণে দলের বিপদও তাড়িয়ে দিবেন।

চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো অনেক কিছুই করেছে বাজবল। কেমন হতো যদি রুট তার সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করতে খেলে ফেলতেন রিভার্স স্কুপ? তিনি বলেন, 'আমাকে স্বীকার করতেই হবে এটা আমার মাথায় সামান্য সময়ের জন্য এসেছিল, কিন্তু এই উইকেটে এটা ভালো অপশন নয়।'

রুট, রিভার্স স্কুপ, চলবে।

(রিফাত বিন জামাল, অতিথি লেখক)

Comments