মায়ের গয়না বিক্রি থেকে জেদি জুরেলের যাত্রা শুরু

ছবি: এএফপি

ধ্রুব জুরেল বায়না ধরেন, ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনবেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস্তবতায় একটু বড়সড়ই বায়না, সহজে পূরণ করার মতো না। বয়স হবে ১১ কিংবা ১২ বছর। এত ছোট জুরেলের কী আর তা বোঝার ক্ষমতা আছে! বলে বসেন, 'ক্রিকেট কিটব্যাগ দাও, নয়তো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।' কী জেদ!

জুরেলের বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন হাবিলদার হিসেবে। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধেও ছিলেন। সেনাসদস্যের মন তো আর সহজেই গলে যাওয়ার কথা না! ছেলে যখন ক্রিকেট কিটের বায়না ধরেছিল, তখন অবসরে চলে যাওয়া নেম সিং জুরেল 'না' বলে দিয়েছিলেন শুরুতেই। বাবার ইচ্ছে ছিল, সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে ছেলে কিংবা সরকারি চাকরিতে ঢুকবে। তাই নেম সিং বলতে একটুও দ্বিধাবোধ করেননি, 'কিট দিব না। সমস্যা নেই, ক্রিকেট ছেড়ে দাও।'

কিন্তু মায়ের মন কী আর মানে! মা তার সোনার গয়নাটাই (চেইন) বিক্রি করতে দিয়ে দেন। ছেলের ক্রিকেট স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল মায়ের সেই বিশাল ত্যাগের কারণেই।

চলমান ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজে টেস্ট অভিষেক হওয়া উপলক্ষে জুরেলের বাবার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল একটা টিভি চ্যানেল। স্ত্রীর গলার চেইন বিক্রি করে ৭২০০ রুপি দিয়ে ওই কিটব্যাগ কেনার কথা বলতে গিয়ে স্বভাবতই তার চোখের জল আর বাধা মানেনি। যখন দেখেন ছেলের জান-প্রাণ ক্রিকেটেই উজাড়, এরপর তিনিও সমর্থন দিয়ে গেছেন। তবে ভাবেননি এত তাড়াতাড়ি তার ছেলের অভিষেক হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

রাঁচিতে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে খেলতে নামা জুরেল নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানেই খুঁজে পান। দ্বিতীয় দিন শেষে ভারত ২১৯ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলে ৭ উইকেট। প্রথম ইনিংসে ৩৫৩ রানের সুবাদে ইংল্যান্ডের লিড তখন ১৩৪ রানের। স্বীকৃত ব্যাটার বলতে বাকি শুধু নিজের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা জুরেল। রাঁচির পিচ সময়ের সাথে ব্যাটারদের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ার জানান দিচ্ছিল। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করার সমীকরণ থাকায় ঘাড়ে বিশাল লিডের বোঝা ওখানেই ভারতকে ছিটকে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছিল।

কিন্তু তৃতীয় দিনে জুরেল যা করে দেখান, সাধারণ দর্শক কেন, ভারতের টিম ম্যানেজমেন্টেরও তা কল্পনায় আসেনি! সেই ক্রিকেট কিটের বায়না ধরা ছোট্ট জেদি জুরেল এবার জেদ দেখান ভারতের জার্সি গায়ে। কুলদীপ যাদবের যোগ্যসঙ্গ পেয়ে খেলতেই থাকেন। কুলদীপ পরে আউট হয়ে যান ২৮ রান করে। বাকিদের নিয়ে কীভাবে কী করবেন, চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায়।

ইংলিশ অধিনায়ক বেন স্টোকস বাউন্ডারিতে পাঁচ-ছয়জন ফিল্ডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন। জুরেল কোনো ঝুঁকি নিতে যাননি। ওভারের চার-পাঁচবল যায়, সিঙ্গেল নিয়ে পরের ওভারে স্ট্রাইক পাওয়ার চেষ্টা করেন। লেজের দিকের ব্যাটারদের সঙ্গে খেলতে গেলে অনেক ব্যাটারকেই ধুন্ধুমার ব্যাটিং করে উইকেট বিলিয়ে আসতে দেখা যায়। জুরেল শান্ত থেকে খেলে যান।

স্পিনারদের ওপরও চড়াও হন সময় বুঝে। শোয়েব বশিরকে যেমন সোজা মারেন ছক্কার পর চার। শেষমেশ তাকে আউট করার জন্য প্রয়োজন পড়ে একটা দুর্দান্ত ডেলিভারির। টম হার্টলির বলে বোল্ড হয়ে যখন জুরেল ফেরেন ৯০ রান করে, সেঞ্চুরির আক্ষেপ ছিল না তার সঙ্গে। ইংল্যান্ডের লিড ততক্ষণে কমে এসেছিল স্রেফ ৪৩ রানে। সেই স্বস্তিটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তখন।

দলের আত্মবিশ্বাসের বেলুনটাও আরেকটু ফুলিয়ে দিয়েছিলেন জুরেল। সেদিন সতীর্থ শুবমান গিলের কথায় বোঝা গিয়েছিল সেটাই, 'যখন লিড ৪০-৫০ রানে এলো, তখন জানতাম, খেলায় আমরা আছি।'

লিড যে একাই তরুণ জুরেল এত কমিয়ে আনবেন, কেউ ভাবেনি। ম্যাচশেষে জিও সিনেমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গিল বলেন, 'দিনের শুরুতে কথা যা হয়েছিল, তা ছিল লিড কমিয়ে ৮০, ৯০ বা ১০০ রানে আনার। এটাই আমাদের পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু যেভাবে ওরা ব্যাটিং করেছে, তা সকলের প্রত্যাশার চেয়ে বেশিই। যেভাবে ধ্রুব ব্যাটিং করেছে, সে খুব পরিণত ব্যাটিং করেছে।'

দ্বিতীয় ইনিংসে এরপর জুরেল নামেন যখন, হ্যাটট্রিক বলের সামনে ছিলেন তিনি। ১৯২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা ভারত ছিল বিপাকে। টানা ২ উইকেট হারিয়ে ১২০ রানেই ৫ উইকেট খুইয়ে ফেলেছিল তারা। স্পিন-সহায়ক অসম বাউন্সের উইকেটে রক্ষণে দৃঢ় ও শান্ত জুরেল যেন চাপের কিছুই গায়ে লাগতে দেননি এরপর। গিলের ৫২ রানের সঙ্গে নিজে ৩৯ রান করে একেবারে ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন।

সেঞ্চুরি মিস হওয়ার আক্ষেপ নয়, সাদা পোশাকে সিরিজ জয়ের স্বপ্নের কথা জুরেল বলেছিলেন গত রোববারের সংবাদ সম্মেলনে। পরদিন ভারতের সিরিজ জয় নিশ্চিত হলো যে ম্যাচ দিয়ে, সেই ম্যাচ জয়ের নায়ক হলেন জুরেলই।

এক সময় যারা বলতেন ছেলেকে কাজে লাগাও, ক্রিকেট খেলে গোল্লায় যাচ্ছে, সেসব আত্মীয়স্বজনের মুখ বন্ধ করতে পেরেছে তার ছেলে। গর্বে এখন বুক ফুলে যায় বাবা নেম সিংয়ের। প্রথম ইনিংসে ফিফটির পর স্যালুট দিয়ে উদযাপন করেছিলেন জুরেল। স্যালুটটা ওই সেনাসদস্য বাবার জন্যেই। মাকে বছর দুয়েক আগেই স্বর্ণের চুড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। তবে মায়ের ঋণ শোধ করার কি সাধ্য আছে জুরেলের দেওয়া কোনো উপহারের!

(রিফাত বিন জামাল, অতিথি লেখক)

Comments

The Daily Star  | English

Sheikh clan’s lust for duty-free cars

With an almost decimated opposition and farcical elections, a party nomination from the ruling Awami League was as good as a seat in the parliament.

7h ago