বিপর্যস্ত মহসিনের আমাদের মনোযোগ প্রাপ্য
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে মোহাম্মদ মহসিনের পারিবারিক ফ্ল্যাট। দরজায় কড়া নাড়ার বেশ কিছু সময় পর ওপাশ থেকে উত্তর আসে। ভেতর থেকে লাগানো তালা খুলতে কেটে যায় আরও কিছু সময়।
মঙ্গলবার এই প্রতিবেদক যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকে বসেন, তখন সেখানে অন্ধকার ছেয়ে আছে। লোডশেডিংয়ের কারণে। আলো পাওয়ার জন্য জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতে হয় তাই। হঠাৎ এই ফ্ল্যাটে যাওয়ার কারণ ছিল– আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় গোলরক্ষক মহসিন। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনের মনোযোগ গেছে তার দিকে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মহসিনের সুস্থতা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার আর্থিক সহায়তা।
তার ছোট ভাই কোহিনূর ইসলাম পিন্টুর ডাকে বেডরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মহসিন। তার পরনে ছিল একটি সাদামাটা টি-শার্ট ও ডোরাকাটা ট্রাউজার। শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকা মহসিনকে এমন নাজুক পরিস্থিতিতে দেখাটা এই প্রতিবেদকের জন্য ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি দিনে মহসিন ছিলেন খ্যাতির চূড়ায়, ফুটবলপ্রেমীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে।
নিঃস্ব ও পীড়িত মহসিনকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন তাই মনে জাগে। খেলা ছাড়ার পর কী ঘটেছে তার জীবনে? এক সময় যার নাম মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো, তার বর্তমান দুরবস্থার পেছনে কারণ কী? ২০১৪ সালে কানাডা থেকে দেশে ফিরলেও সাম্প্রতিক সময়েই কেন তিনি আলোচনায়?
সব উত্তর অবশ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাকে বর্তমানে দেখাশোনা করতে থাকা পিন্টু তার বড় ভাই মহসিনের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার বিষয়টি কেবল স্পষ্ট করেন। পিন্টু আরও জানান, তারা অতীতে কখনও কারো কাছে সাহায্যের জন্য যাননি। তবে মহসিনের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার জন্য সহায়তার প্রয়োজনীয়তা সম্প্রতি তারা অনুভব করছেন।
৬০ বছর বয়সী মহসিনের আচরণ ছিল খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ। কথা বলার সময় মুখে হাসি লেগে থাকে। তবে কোনো কথোপকথনই তিনি পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। একটু পর পরই অসংলগ্নভাবে কিছু কথা বার বার বলতে থাকেন। একটানা বেশিক্ষণ বসেও থাকেন না, ছটফট করেন। খেলোয়াড়ি দিনগুলোর পাশাপাশি জীবনের কোনো স্মৃতি ভালোভাবে মনে করতে পারেন না।
'আপনারা এসেছেন, ভালো হয়েছে। আবার আসবেন,' ৩০ মিনিটের আলাপে এই কথাগুলো প্রায় ১৫ বার বলেন মহসিন। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক এই গোলরক্ষক কিছু বাক্যই বার বার ব্যবহার করেন– 'আপনারা জুতা পরে বসুন। আপনার আঙুলে কী হয়েছে? আমি আমেরিকার চেয়ে কানাডাকে বেশি পছন্দ করি। আবাহনী আমাকে ২২ কোটি টাকা দেবে বলেছে।'
এখন কীভাবে সময় কাটে জানতে চাইলে মহসিন বলেন, 'আমার মা খুব অসুস্থ। আমি সারাদিন বাড়িতেই থাকি। মায়ের চিন্তা করে আমি আর কানাডায় ফিরে যাইনি।'
কথোপকথনের এক পর্যায়ে মহসিন আরেকটি রুমে গিয়ে কিছু পুরনো ছবি নিয়ে ফিরে আসেন। তার খেলোয়াড়ি জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতি সেসবে ধরে রাখা। এই প্রতিবেদক যখন সেগুলো নিয়ে জানতে চান, তখন মহসিনের চোখ যেন রোমাঞ্চে চকচক করে ওঠে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী দুটি ক্লাব– আবাহনী ও মোহামেডানে খেলেছেন তিনি। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিনিধিত্বও করেছেন। অনুশীলন সেশনে তাকে এক নজর দেখার জন্যও এক সময় ভিড় জমত।
'এখন ফুটবল কোথায় গেল? ফুটবল তো সেই আগের ফুটবল নেই। আমাদের সময় প্রচুর দর্শক আসত, এখন তো আসে না। আমি আবাহনী, মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধাতে খেলেছি। তবে বেশি ভালো লাগত আবাহনীর হয়ে খেলতে,' বলেন মহসিন।
ঝলমলে ক্যারিয়ারের ইতি টেনে ১৯৯৭ সালে মহসিন আমেরিকায় পাড়ি জমান। ছিলেন নয় মাস। এরপর চলে যান কানাডা। সেখানে বাস্কেটবল ও আইস হকির সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ক্লাবের স্টোরে চাকরি করতেন। কানাডায় থাকাকালীনই প্রবাসী এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেন মহসিন। তারপর মায়ের অসুস্থতা ও সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়। এরপর আরা কানাডায় কখনও যাননি মহসিন।
মহসিনের বর্তমান বিপর্যস্ত অবস্থা নিয়ে পিন্টু বলেন, 'সমস্যা হলো, সে সবকিছু ভুলে যায়। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে এটা বেশি হচ্ছে। তাই সে যাতে বাইরে বেরিয়ে কোথাও চলে যেতে না পারে, তাই আমরা দরজা ভেতর থেকে তালা মেরে রাখি।'
'অসুস্থ মাকে দেখার জন্য আমার ভাই দেশে ফিরেছিল। এরপর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর ফেরত যায়নি। সংসার না টেকার পর সে দেশে কিছু (অর্থ বা অন্য সম্পদ) নিয়েও আসতে পারেনি। আমি গাড়ি ভাড়া করে তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছিলাম। কোনো কিছু করার ক্ষেত্রেই তার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করত,' মহসিন কেন ফেরার পর ব্যবসা বা ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি জানতে চাইলে জবাব দেন পিন্টু।
বড় ভাইয়ের দেখভাল করতে গিয়ে পিন্টুকে অনলাইনে কাপড় বিক্রির ব্যবসা ছাড়তে হয়েছে। তাদের প্রয়াত বাবার পেনশন ও বোনদের সহায়তায় কোনোক্রমে চলছে সংসার। তবে মহসিনের চিকিৎসার জন্য দরকারি অর্থের যোগান মিলছে না বলে জানান পিন্টু, 'আগে আমরা কোনো আর্থিক সাহায্য চাইনি কারও কাছে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সুস্থতার জন্য এখন সেটা আমাদের প্রয়োজন। যদি সরকার আমার ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসে, খুবই ভালো হয়।'
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদীর কাছে সম্প্রতি সহায়তা চাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সাভারে আমাদের ৬৭ শতাংশ জমি আছে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা তা দখল করে রেখেছে। সরকার যদি সেই জমিটা উদ্ধারে আমাদের সাহায্য করে, তাহলেও উপকার হয়। জমির কিছু অংশ বিক্রি করে ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে পারব।'
এই প্রসঙ্গে সালাউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, 'আমি মহসিনের ব্যাপারে গতকাল (সোমবার) জানতে পেরেছি। আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। আমি অবশ্যই তার সুস্থতা নিশ্চিতের জন্য যা যা দরকার তা করব।'
মহসিনের সঙ্গে খেলা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক ফুটবলার বলেন, 'মহসিনের চেহারার দিকে তাকালেই আপনি বুঝতে পারবেন যে আসলে কী ঘটেছে। তবে যা ঘটার তা ঘটেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হলো তার পাশে দাঁড়ানো যাতে তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারেন। তিনি একজন বিখ্যাত খেলোয়াড়, আমাদের মনোযোগ তার প্রাপ্য।'
সংকটে পড়া মহসিনের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তার চিকিৎসায় সহায়তা করার পাশাপাশি জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাপারে আইনি সহায়তা দিতে চায় তারা। আরও অনেকে দেশের ফুটবলের স্বর্ণ সময়ের ফুটবলারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন, এটাই প্রত্যাশা।
Comments