‘জোগো বনিতায়’ মাতোয়ারা দোহা 

কোরিয়ার জালে ব্রাজিলের গোল উৎসবের পর কাল উৎসব হলো স্টেডিয়ামের বাইরে, দোহা শহর পুরো হলুদ রঙে ছেয়ে গেল। গান বাজনা আর ব্রাজিল সমর্থকদের উল্লাস দেখতে দেখতে রাতের দোহা কখন যে সকাল হয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি।
World Cup Football Fan

'জোগো বনিতা' মানে সুন্দর ফুটবল। এই সুন্দর ফুটবল দেখতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্বকাপ দেখতে ছুটে আসেন দর্শক-সমর্থকরা। সাম্বার ছন্দে মাঠে এই সুন্দর ফুটবল খেলে ব্রাজিল। কাল দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে যেমনটি খেললো। আর মাঠে ব্রাজিলের সেই 'জোগো বনিতা' বা সুন্দর ফুটবলে বিধ্বস্ত হলো অনেক আশা জাগিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে আসা এশিয়ার দল দক্ষিণ কোরিয়া। আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার ভাগ্যই এখানে খারাপ। গ্রুপ পর্বে উরুগুয়েকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে এলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যে তাদেরকে পড়তে হয় মহা পরাক্রমশালী ব্রাজিলের সামনে। এই সেই ব্রাজিল, ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল দলের মতো এবারের ব্রাজিল দল বিশ্বকাপ নিয়ে বাড়ি ফিরবে- তাদের পক্ষে এই বাজি ধরছে বেশিরভাগ! 

ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে কাতারে খেলা দেখতে এসেছেন লুকাস সান্তিয়াগো দম্পতি। লুকাসের এটাই প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে আসা নয়। ২০০২ সাল থেকে তিনি বিশ্বকাপে মাঠে বসে ব্রাজিলের খেলা দেখছেন। মাঠে বসে সাক্ষী হয়েছেন ২০০২ সালের ব্রাজিলের পঞ্চম বিশ্বকাপ জয়ের। ব্রাজিলের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয় দেখতে তিনি এরপর থেকে  ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহাদেশ থেকে মহাদেশে, বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপে। সান্তিয়াগো জানালেন- 'এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের যে দল সেটা হেক্সা জয় করবেই। এমন ব্যালেন্সড আর আক্রমণাত্মক দল বিগত কয়েকটি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ছিল না। কিন্তু এবারের ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে তিতে অভিজ্ঞদের সাথে তারুণ্যের মিশেলে যে দল সাজিয়েছেন সেই দল খালি হাতে ফেরার নয়!' 

World Cup Football Fan

এবারের ব্রাজিল দল মাঠে বসে তাকে আরেকটি বিশ্বকাপ জয় দেখাবে এমন বিশ্বাস সান্তিয়াগোর। এমন স্বপ্ন আর বিশ্বাস নিয়ে কাতারে খেলা দেখতে এসেছেন ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর তরুণী জোয়ানাও। এবারই জোয়ানার বিশ্বকাপে খেলা দেখতে প্রথম ছুটে আসা। রিও ডি জেনিরোর মেয়ে হলেও তিনি কাজে করেন আমাজন জঙ্গলের কাছাকাছি ছোট একটি শহরের রিসোর্টে। বিশ্বকাপের জন্য এক মাসের ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন কাতারে। আর জোয়ানা মনে করেন, পুরো এক মাসই তিনি কাতারে থাকার সুযোগ পাবেন। তাকে এই সুযোগটা করে দিবে ব্রাজিল দল। কারণ ব্রাজিল যতদিন বিশ্বকাপে থাকবে, জোয়ানা ততদিনই কাতারে থাকবেন। জোয়ানার স্বপ্ন তার প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে আসা স্মরণীয় করে রাখবেন নেইমাররা। 

World Cup Football Fan

হেক্সা জয়ের মিশনে নেইমারেই ভরসা রাখছেন ব্রাজিলিয়ানরা। প্রথম রাউন্ডে দুই ম্যাচ খেলা হয়নি নেইমারের। আর এই দুই ম্যাচে ব্রাজিলও খেলেনি ব্রাজিলের মতো। ক্যামেরুনের সঙ্গে তো মূল দলের প্রায় সব খেলোয়াড়কে বসিয়ে রেখে বেঞ্চের খেলোয়াড় দিয়ে খেলাতে গিয়ে ম্যাচই হেরে বসে ব্রাজিল। কিন্তু কাল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে যার উপরে সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখছে সেই নেইমার মাঠে নামতেই যেন বদলে গেল পুরো দল। খেলা শুরুর আগে হালকা শরীর গরম করতে ব্রাজিল দল মাঠে নামলো তখনই নেইমারকে মাঠে অনুশীলনে নামতে দেখে করতালিতে ফেটে পড়ে পুরো 'স্টেডিয়াম ৯৭৪'। তারপর তিনি মাঠে নামলেন, ব্রাজিল দলের প্রাণ ভোমরা হয়ে মাঠে ব্রাজিলের আক্রমণে নেতৃত্ব দিলেন, গোল করলেন, অনবদ্য ফুটবল উপহার দিয়ে ম্যাচ সেরা হলেন। 

World Cup Football Fan

নেইমারকে সামনে রেখে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে। নেইমারও ব্রাজিলের কোটি মানুষ আর বিশ্বজুড়ে ব্রাজিল ভক্ত-সমর্থকদের স্বপ্ন  টেনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বকাপ জয়ের দিকে। কিন্তু নেইমার ছাড়া এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের আক্রমণে আরেকজন হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য, অবিশ্বাস্য। তিনি রিচার্লিসন। এই বিশ্বকাপকে যেন তিনি বেছে নিয়েছেন নিজের জাত চেনানোর জন্য। প্রথম রাউন্ডে বাইসাইকেল কিকে অবিশ্বাস্য এক গোল করার পর কাল করলেন অবিশ্বাস্য আরেক গোল। মাথা, পা, ড্রিবলিং এর অনবদ্য সমন্বয়ে কাল কোরিয়ার বিপক্ষে রিচার্লিসন যে গোল করলেন সেই গোল চেয়ে দেখা আর কিছুই করার ছিল না কোরিয়ানদের। বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত যে কয়টি গোল হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রিচার্লিসনের এই দুটি গোল সেরা গোলের মধ্যেই আছে। মাঠে বসে এমন ফুটবল আর এমন গোল দেখতেই ছুটে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। 

World Cup Football Fan

ম্যাচের প্রথমার্ধ শেষ হতেই আমার পাশে বসে থাকা ব্রাজিলিয়ান ভ্যালেন্টিনার সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। সে এসেছে ব্রাসিলিয়া থেকে, বিমান সেবিকা হিসেবে কাজ করে ব্রাজিলের লাটাম এয়ারলাইন্সে। ব্রাজিলের সব কটি ম্যাচের কন্ডিশনাল টিকেট কেটে এসেছে, মানে ব্রাজিল যে কয়টি ম্যাচ খেলবে সে সেই ম্যাচগুলোতে গ্যালারিতে থাকবে। কর্মস্থল থেকে সে ছুটিও নিয়েছে সে বড় অদ্ভূত। কন্ডিশনাল টিকেটের মতো কন্ডিশনাল ছুটি। ব্রাজিল যদি বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত যায়, তাহলে তার ছুটি বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত। ব্রাজিল যদি তার আগে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে তাহলে তার ছুটিও সেখানে শেষ। ভ্যালেন্টিনার মতো কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে আমার টিকেটগুলো কন্ডিশনাল। ব্রাজিল যতদূর যাবে, আমার মাঠে বসে বিশ্বকাপ দেখাও তত-দূর। ব্রাজিলের পারফর্মেন্সের উপরেই নির্ভর করছে আমার আর ভ্যালেন্টিনার মাঠে বসে বিশ্বকাপ দেখার ভাগ্য। তাই ভ্যালেন্টিনাকে জিজ্ঞেস করলাম- ব্রাজিল এই বিশ্বকাপে কতদূর যাবে? ভ্যালেন্টিনা হাসতে হাসতে বললো- আমার পুরো ছুটিটা অন্তত কাটাতে দিবে!    
 
কোরিয়ার জালে ব্রাজিলের গোল উৎসবের পর কাল উৎসব হলো স্টেডিয়ামের বাইরে, দোহা শহর পুরো হলুদ রঙে ছেয়ে গেল। গান বাজনা আর ব্রাজিল সমর্থকদের উল্লাস দেখতে দেখতে রাতের দোহা কখন যে সকাল হয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি। সকালে দোহার বিন মাহমুদ মেট্রো স্টেশনে বাসায় ফেরার জন্য যখন নেমেছি তখন দোহার ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া মেট্রো কর্মীদের মতো, মেট্রো কর্মীদের মতো করে ব্রাজিলিয়ানরা কোরিয়ানদেরকে বলছিল- 'এক্সিট দিস ওয়ে!'' ব্রাজিলিয়ানদেরকে বলছিলো- 'ফাইনাল দিস ওয়ে!' 

কোরিয়ার জালে গোল উৎসবের স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে কানে বাজছিল ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের সুরে সুরে বলা সেই কথাই- 'ফাইনাল দিস ওয়ে!' 
 লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক। লেখায় ব্যবহৃত ছবি লেখকের। 

Comments