মিরাজের বীরত্বে অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় ভারতকে হারাল বাংলাদেশ

৯৬ বলে দরকার ছিল ৫৯ রান, হাতে ৬ উইকেট। এই ম্যাচ হারাটাই যেন কঠিন কাজ। বিস্ময়কর ব্যাটিং ধ্বসে বাংলাদেশ সেটাই যেন করে ফেলেছিল। ১৩৬ রানেই পড়ে গিয়েছিল ৯ উইকেট। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। শেষ উইকেটে মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে ৫১ রান তুলে প্রায় 'মিরাকল' ইনিংস খেলে ম্যাচ জেতালেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
রোববার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোমাঞ্চকর ম্যাচে ভারতকে ১ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করে ভারত অলআউট হয় ১৮৬ রানে। ২৪ বল আগে ওই রান পেরিয়ে জিতেছে স্বাগতিকরা। তিন ম্যাচ সিরিজে লিটন দাসের দল এগিয়ে গেছে ১-০ ব্যবধানে।
বল হাতে ৩৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ভারতকে দুইশর নিচে আটকে দেওয়ার নায়ক তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। রান তাড়ার শুরুতে অধিনায়ক লিটন খেলেন ৪১ রানের ইনিংস। তবে তাদের ছাপিয়ে নায়ক অলরাউন্ডার মিরাজ। প্রায় নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচে প্রাণ ফেরান তিনি। ৩৯ বলে ৩৮ রানের অপরাজিত স্মরণীয় ইনিংসে জয়ের মূল কৃতিত্ব মূলত তার।
মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে শেষ উইকেট জুটিতে ৪১ বলে ৫১ রান যোগ করেন মিরাজ। যার মধ্যে ৩৭ রানই আসে তার ব্যাট থেকে। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে পেসার মোস্তাফিজ অপরাজিত থাকেন ১১ বলে ১০ রানে।

১৩৬ রানে ৯ উইকেট শেষ, আরেক পাশে তখন মোস্তফিজ। মিরাজ নিজের উপরই আস্থা রাখলেন। কুলদীপ সেনের ওভারে ২ ছক্কায় তার ঝলকের শুরু। দীপক চাহারের ওভারে মারেন তিন বাউন্ডারি। ১৫ রানে অবশ্য সুযোগ দিয়েছিলেন মিরাজ। শার্দুল ঠাকুরের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে আকাশে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। উইকেট কিপার লোকেশ রাহুল অনেকখানি দৌড়ে গিয়ে ধরতে পারেননি সেই ক্যাচ।
এরপর আর কোন সুযোগ দেননি তিনি। শিশির ভেজা মাঠের সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন পুরোটা। ভারতের বোলারা শেষে দিকে বল গ্রিপ করতেও ভুগছিলেন। মিরাজ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে টেল এন্ডারকে আগলে রাখলেন, নিজেই তুললেন শেষ করার দায়িত্ব। চাহারের বলটা কাভার দিয়ে ঠেলে জয়সূচক রান নিয়ে করলেন বুনো উল্লাস।
এই ম্যাচটা কেন এই পরিস্থিতে এলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বিস্তর। ৪ উইকেটে ১২৮ থেকে ২৭ বলের মধ্যে ১৩৬ রানে ৯ উইকেটে পরিণত হয় বাংলাদেশ। মাত্র ৮ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে হারের দোয়ারে চলে যায় দল। সেই পরিস্থিতি থেকে নাটকীয়ভাবে দলকে ফেরান মিরাজ।
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে মিডল অর্ডার ব্যাটারদের। আপাতত জেতার আনন্দ সেসব প্রশ্ন হয়ত চাপা পড়বে।
১৮৭ রান তাড়ায় নেমে প্রথম বলেই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। চাহারের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনে নামা এনামুল হক বিজয়কে নিয়ে এরপর শুরু হয় অধিনায়ক লিটনের লড়াই।
চাহার ও মোহাম্মদ সিরাজ দারুণ লাইন-লেন্থে বল করে চেপে ধরেন স্বাগতিক ব্যাটারদের। আসতে থাকে একের পর এক ডট বল। দ্বিতীয় উইকেটে তারা ২৬ রান আনেন ৫৪ বল খেলে।
উইকেটের কন্ডিশন পড়ে ভারতীয় বোলারদের তৈরি করা চাপে কাবু হন বিজয়। ২৯ বল খেলে দুই চারে ১৪ করে বিদায় নেন তিনি। মিডউইকেটে চিপ করতে গিয়ে সহজ ক্যাচে থামে তার দৌড়। এর খানিক আগে এলবিডব্লিউ থেকে রক্ষা পান রিভিউ নিয়ে।
অধিনায়ক লিটন অনেকটা সময় নিয়ে থিতু হন। অফ স্টাম্পের বাইরের চ্যানেলে বারবার ভুগছিলেন, কিন্তু হাল না ছেড়ে অপেক্ষা করতে থাকেন বাজে বলের। বাজে বল পেয়ে পুরোটা তুলেও নিচ্ছিলেন তিনি।
সিরাজকে এক্সট্রা কাভার দিয়ে দেখার মতো চার, স্কয়ার লেগ দিয়ে সীমানা ছাড়া করার পর কুলদীপ সেনের বলে উড়ান ছক্কায়। শুরুর জড়তা পার করে বেশ সাবলীল হয়ে যায় তার ব্যাট। সাকিবের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ৬১ বলে তুলেন ৪৮ রান।
লিটন আউট হন ফিফটির কাছে গিয়ে। ওয়াসিংটন সুন্দরের বল ফাইন লেগে গ্লান্স করতে গিয়েছিলেন। ব্যাটে লেগে ক্যাচ যায় কিপারের হাতে। ৬৩ বলে তিন চার, ১ ছক্কায় বাংলাদেশ অধিনায়ক ফিরে যান ৪১ রান করে।
বোলিংয়ের হিরো সাকিব লিটন আউটের পর নিজেকে মেলে ধরেন। হিসেবী শটে বাউন্ডারি বের করে কমান রানের চাপ। তবে কাজটা অসমাপ্ত রেখে ফেরেন সাকিব।
সুন্দরের বলটা পড়তে পারেননি সাকিব, বাউন্সের তারতম্যে হকচকিয়ে যান। ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্যাচ যায় কাভারে। সেখানে উড়ন্ত কোহলি হাতে জমান দুর্দান্ত ক্যাচ।
এরপর জুটি বেধে বাকি কাজ সারার দায়িত্ব পড়ে মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকুর রহিম। দুই অভিজ্ঞ ক্রিজে যাওয়ার পর থেকেই ছিলেন আড়ষ্ট। রান বের করতে কাহিল দশা হচ্ছিল তাদের। একের পর এক ডট ডেলিভারিতে নিজের উপরও বাড়াচ্ছিলেন চাপ।
পঞ্চম উইকেটে ৩৩ রান তুলতে দুজন খেলেন ৬৯ বল। শার্দুলের ভেতরে ঢোকা বলে আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে লাইন মিস করেন মাহমুদউল্লাহ। ৩৫ বলে ১৪ রান করে ফেরেন তিনি। এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি।
পরের ওভারে ইতি মুশফিকের। সিরাজের বল থার্ড ম্যানে ফেলে প্রান্ত বদল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বল ভেতরের দিকে লেগে ভেঙে দেয় তার স্টাম্প। ৪৫ বলে ১৮ রান করেন বাংলাদেশের কিপার ব্যাটসম্যান।
সাতে নামা আফিফ হোসেন দলকে দিতে পারেননি ভরসা। কুলদীপের বলে কাট করতে গিয়ে ক্যাচ দেন বাউন্ডারি লাইনে। পরের ওভারে সিরাজের বলে হিট উইকেটে বিদায় নেন ইবাদত। হাসান মাহমুদকে এলবিডব্লিউতে ফেরান সিরাজ।
তখন কত হারে হারবে এই নিয়ে হতে পারত আলাপ। সেই আলাপকে ভুল প্রমাণ করে নিজেকে চেনান মিরাজ।
এর আগে বাংলাদেশের জেতার ভিত গড়ে দেয় বোলিং। মিরপুরের মন্থর উইকেটে নির্দ্বিধায় প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে দিয়ে চাপ তৈরি করে বাংলাদেশ। ৬ষ্ঠ ওভারে শেখর ধাওয়ানকে ফিরিয়ে প্রথম ব্রেক থ্রো আনেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
অধিনায়ক রোহিত অবশ্য খেলছিলেন সাবলীল। অধিনায়ক রোহিত অবশ্য খেলছিলেন সাবলীল। চিন্তা বাড়াতে পারতেন তিনিই, মিরপুরের মাঠে সবচেয়ে সফল বিরাট কোহলিও যোগ দিয়েছিলেন তার সঙ্গে। একাদশ ওভারে তিন বলের ব্যবধানে এই দুজনকেই ফিরিয়ে দেন সাকিব।
সাকিবের মোহনীয় আর্ম বল বুঝতে না পেরে বোল্ড হয়ে যান রোহিত। কোহলির উইকেটে অবশ্য বড় কৃতিত্ব লিটনের। সাকিব ড্রাইভ খেলেছিলেন, কাভারে দাঁড়িয়ে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতায় লিটন ক্যাচ জমান হাতে। পর পর দুই উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে যাওয়া ভারতকে পথ দেখার চেষ্টা শুরু হয় রাহুলের। শ্রেয়াস আইয়ারকে নিয়ে তার জুটিটা জমেও উঠেছিল। আইয়ারের ভুলেই থামে তা। ইবাদতের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে ব্যাটে নিতে পারেননি ইবাদত। টপ এজ হয়ে ক্যাচ উঠে যায় সোজা।
সুন্দরকে নিয়ে এরপর লড়াই শুরু রাহুলের। বাকিদের ভোগান্তির মাঝে যেন অনেকটা ভিন্ন উইকেটে ব্যাট করছিলেন তিনি। অনায়াসে বের করছিলেন বাউন্ডারি। সুন্দরকে একপাশে রেখে জুটি ছাড়িয়েছিল পঞ্চাশ। ৩৩তম ওভারে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেন সুন্দর। ৬০ রানের জুটির পর সাকিবকে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে পয়েন্ট ক্যাচ দেন সুন্দর।
এরপরই ধসে যায় ভারতের ওয়ার মিডল অর্ডার। শাহবাজ আহমেদ টিকতে পারেন ৪ বল, দীপক চাহার ও শার্দুল ঠাকুর তিন বল। ইবাদত ছাঁটেন শাহবাজকে। সাকিব ফেরা বাকি দুজনকে। একা লড়াই চালাতে থাকা রাহুল ৪০তম ওভারে আউট হলে আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি ভারত।
Comments