ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর গল্প

একসময় 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' বলা হতো অলিম্পিককে। তবে সেই তকমা এখন গায়ে জড়িয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ। আর এই জায়গায় আসতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি খেলাটিকে। যে দেশে ফুটবলের জন্ম, সেই ইংল্যান্ডই তীব্র বিরোধিতা করেছিল বিশ্বকাপ আয়োজনের। তাচ্ছিল্য করে প্রথম তিন আসরে তো অংশই নেয়নি দেশটি। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেঁকে বসেছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা স্কটল্যান্ডও। সেই ফুটবল বিশ্বকাপই এখন পৃথিবীর জনপ্রিয় ক্রীড়া উৎসব।

ফুটবল তখন খেলত গুটি কয়েক দেশ। তারপরও অলিম্পিকের দ্বিতীয় আসরেই জায়গা পেয়ে যায় এ খেলা। তখন অবশ্য এক দেশেরই একাধিক দল অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল। তবে ১৯০৮ অলিম্পিকে আয়োজক হয়ে এ নিয়ম বদলে দেয় ইংল্যান্ড। কেবল জাতীয় দলকেই আমন্ত্রণ জানায় তারা। লন্ডন অলিম্পিকেই বাড়ে ফুটবলের মর্যাদা। এরপর বাকিটা যেন ম্যাজিক। ২০ বছরের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ে তরতরিয়ে। ১৯২৪ ও ১৯২৮ অলিম্পিকেই মূল আকর্ষণই ছিল ফুটবল।

আর ফুটবলের এমন তীব্র জনপ্রিয়তায় তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলেরিমের মাথায় খেলে নতুন বুদ্ধি। ফুটবল নিয়ে আলাদা একটি বৈশ্বিক আসরের কথা ভাবেন। তবে আগেও এমন চেষ্টা হয়েছিল। ১৯০৪ সালে ফিফা প্রতিষ্ঠার দুই বছর পরই অলিম্পিকের আদলে টুর্নামেন্টের কথা ভেবেছিলেন তারা। ১৯০৯ সালে ইতালির তুরিনে 'থমাস লিপ্টন কাপ' নামে একটি টুর্নামেন্টও আয়োজন করা হয়। তবে জাতীয় দলগুলো আগ্রহ না দেখানোয় আর এগোয়নি।

তেতো অভিজ্ঞতা ভুলে ফুটবলের নতুন জোয়ার কাজে লাগাতে উদ্যোগী হন জুলেরিমে। বাধ সাধে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। সরাসরি নাকচ করে দেয় সংস্থাটি। ফুটবলের জনপ্রিয়তার কথা ভেবে ফিফাও দমবার পাত্র নয়। ফিফার মরিয়া মনোভাব দেখে শাস্তিস্বরূপ ১৯৩২ লস অ্যাঞ্জেলসে ফুটবল বাদ দেয় অলিম্পিক কমিটি। তখন বাধ্য হয়েই তড়িঘড়ি বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। জুলেরিমে ঠিক করেন তার নিজের নামেই হবে এ টুর্নামেন্ট।

শুরু হয় বিশ্বকাপের আয়োজনের প্রস্তুতি। কিন্তু আয়োজনটা হবে কোথায়? ইউরোপ থেকেই স্বাগতিক হওয়ার ইচ্ছা জানায় পাঁচ দেশ -ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও হাঙ্গেরি। ল্যাতিন আমেরিকা থেকে আগ্রহী উরুগুয়ে। ওই বছরই আবার স্বাধীনতার শতবার্ষিকী পূরণ হবে ল্যাতিন দেশটির। বাকি ল্যাতিন দেশগুলো সমস্বরে সমর্থন দেয় তাদের। ফলে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার সুযোগটা পেয়ে যায় উরুগুয়ে।

ফিফার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। আয়োজনের দায়িত্ব না পেয়ে আয়োজক হতে ইচ্ছুক পাঁচ দেশই অংশ নিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে দেয়। তাদের যুক্তি, আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া ব্যয়বহুল। সব খরচ উরুগুয়ে বহন করার শর্তেও রাজী হয়নি তারা।

শেষ পর্যন্ত চারটি ইউরোপিয়ান দেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যায়। এতে দারুণ ভূমিকা রাখেন তৎকালীন রোমানিয়ার রাজা ক্যারল। বিশ্বকাপ দল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেই। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে উদ্বুদ্ধ করেন। বিশ্বকাপ শেষে দলের খেলোয়াড়দের টাকা এমনকি চাকুরী দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। ফলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয় রোমানিয়া, বেলজিয়াম, যুগোস্লাভিয়া ও ফিফা সভাপতির দেশ ফ্রান্স। রোমানিয়া, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম একই জাহাজ 'এসএস কন্তে ভার্দে'তে চড়ে উরুগুয়ে পৌছায়। যাত্রা পথে বাজিল দলও ওই জাহাজে তাদের সঙ্গী হয়। একমাত্র এই একটি বিশ্বকাপেই ইউরোপের চেয়ে ল্যাতিন দলের সংখ্যা ছিলো বেশি।

উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে তিনটি ভেন্যুতে আয়োজিত হয় প্রথম বিশ্বকাপ। অংশ নেয় ১৩ দেশ। ইউরোপের চারটি দেশের সঙ্গে ল্যাতিন আমেরিকার ছিলো ৭টি দল – পেরু, প্যারাগুয়ে, চিলি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বলিভিয়া ও উরুগুয়ে। বাকি দুটি দল উত্তর ও মধ্য আমেরিকার -মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো। ১৩ থেকে ৩০ জুলাই। ১৮ দিনে হয়েছে পুরো আসর। একমাত্র এই আসরেই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী কোন ম্যাচ ছিলো না।

১৩ দলকে চার ভাগে বিভক্ত করে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আসর। প্রতিটি গ্রুপে তিনটি করে দল থাকলেও 'এ' গ্রুপে রাখা হয় চারটি দল। ফ্রান্স এবং মেক্সিকোর মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপের আসর। সে ম্যাচে ৪-১ গোলের জয় পায় ফরাসীরা। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম গোলটি করেন ফ্রান্সে লুসিয়ান লরাঁ। বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিল নিজেদের প্রথম ম্যাচে ০-১ গোলে হেরেছিল যুগোস্লাভিয়ার কাছে।

প্রতিটি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দলকে নিয়ে সেমিফাইনাল। তাতে নিজ নিজ খেলায় জয় তুলে ফাইনালের টিকেট কাটে উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। এই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে রোমানিয়া ও পেরুর মধ্যকার ম্যাচে মাত্র ৩০০ জন দর্শক উপস্থিত ছিলো। যা বিশ্বকাপের কোন ম্যাচে সর্বনিম্ন উপস্থিতির রেকর্ড।

তবে ফাইনালে উপস্থিত ছিলেন ৯৩ হাজারেরও বেশি দর্শক। তবে এতে হয়েছে বিপত্তিও। আর্জেন্টিনার লুইস মন্টিকে খুনের হুমকি দেয় উরুগুয়ের দর্শকরা। এর জেরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আর্জেন্টাইন শিবিরে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়েই উপস্থিত সকল দর্শকদের তল্লাশি করতে বলেন রেফারি। উদ্ধার হয় ১৬০০টি রিভলভার।

তবু থামছিল না উত্তেজনা। বল নিয়ে নতুন গণ্ডগোল। তখন ফিফার নিজস্ব বল ছিলো না। দলগুলোর বল দিয়েই খেলা হতো। কিন্তু দুই দলই চায় নিজেদের বল নিয়ে খেলতে। টস পদ্ধতিও মানতে চায় না কেউই। শেষে সিদ্ধান্ত হয় প্রথমার্ধে খেলা হবে আর্জেন্টিনার বল দিয়ে, আর দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের। মজার ব্যাপার হলো নিজেদের বলে দুই দলই ছিলো দুর্দান্ত। তবে উরুগুয়ে সুবিধাটা কাজে লাগায় বেশি। প্রথমার্ধে নিজেদের বল দিয়ে ২টি গোল দেয় আর্জেন্টিনা। আর দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ে দেয় ৪টি গোল। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপায় চুমু খায় উরুগুয়ে।

তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ না থাকায় গ্রুপ পর্বের ফলাফল বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় নির্বাচিত করে ফিফা। ৩টি হ্যাটট্রিকসহ মোট ৭০টি গোল হয় প্রথম বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিকটি করেন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ট পেটানভ। তবে সবচেয়ে বেশি গোল করে আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন আর্জেন্টিনার গুলেইর্মো স্ট্যাবিল। ৮টি গোল দেন এ আর্জেন্টাইন।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago