লুইস সুয়ারেজ: পাগলাটে এক ফুটবল দৈত্য
সময়ের সঙ্গে ক্রমেই বাড়ছে কাতার বিশ্বকাপের উত্তাপ। মরুর বুকে সাফল্যগাঁথা লিখতে মুখিয়ে আছে অংশ নিতে যাওয়া ৩২টি দলই। বিশেষত তারকাবহুল দলগুলো শিরোপাজয় ছাড়া ভাবছে না অন্য কিছুই। এদিকে অনেক তারকাই সময়ের ফেরে চলে এসেছেন ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে। ফলে বুট তুলে রাখার আগে একবার অন্তত বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরাই লক্ষ্য তাদের। ৩৫ বছর বয়সী লুইস আলবের্তো সুয়ারেজ দিয়াজের জন্যও ২০২২-ই হতে পারে এই গৌরব অর্জনের শেষ সুযোগ।
১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কখনোই ফুটবলের সর্বোচ্চ মর্যাদার ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি সুয়ারেজের। ২০১০ সালে শিরোপার খুব কাছে যেয়েও আক্ষেপে পুড়তে হয়েছিল তাকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ঘানার বিপক্ষে হাত দিয়ে নিশ্চিত গোল ঠেকিয়ে উরুগুয়ের জাতীয় নায়কে পরিণত হন এই স্ট্রাইকার। ফুটবলের নিয়ম বহির্ভূত কাজ করে দেখেছিলেন লাল কার্ডও। পেনাল্টি পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি ঘানা, ম্যাচ গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে। সেই লড়াইয়ে পেরে ওঠেনি 'কালো তারারা'। ফলে ১৯৭০ সালের পর প্রথমবারের মতো উরুগুয়ে সেমিফাইনালে ওঠে অনেকটা সুয়ারেজের সেই অবদানেই।
কিন্তু লাল কার্ডের নিষেধাজ্ঞায় শেষ চারের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাঠে নামা হয়নি তার। সাইডলাইনে বসেই সেদিন হারের বেদনায় পুড়তে হয় সুয়ারেজকে। এরপর কেটে গেছে আরও দুটি বিশ্বকাপ। কিন্তু সাফল্যের বিচারে ২০১০ এর আসরকে পার করতে পারেনি উরুগুয়ে। ২০১৪ সালে শেষ ষোলই পার করতে পারেনি লা সেলেস্তেরা। তবে বিশ্বমঞ্চে সুয়ারেজ খেলবে আর বিতর্কের সৃষ্টি হবে না তা কি করে হয়! সেবারও অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটান তৎকালীন লিভারপুল 'নম্বর সাত'।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কামড়ে দেন ইতালির ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে। এমন শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করে ক্রীড়া আদালতের রায়ে পান আন্তর্জাতিক ফুটবলে নয় ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা। সেই সঙ্গে জুটে সব ধরণের ফুটবল থেকে চার মাস দূরে থাকার কঠিন শাস্তিও। নকআউট পর্বে সুয়ারেজকে ছাড়া সেবারও আত্মসমর্পণ করে উরুগুয়ে। কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা। ২০১৮ সালে নিজের প্রথম দুই বিশ্বকাপের তুলনায় দেখা মিলে বেশ পরিণত এক সুয়ারেজের। সেবার কোয়ার্টার পর্যন্ত গেলেও ফ্রান্সের বিপক্ষে হেরে থামে উরুগুয়ের যাত্রা।
সুয়ারেজের শুরুটা হয়েছিল নিজ দেশের ঘরোয়া লিগ প্রিমেরা ডিভিশনে। সেখানকার ক্লাব ন্যাসিওনালের বয়সভিত্তিক দলে আলো ছড়িয়ে ২০০৫ সালে সুযোগ পেয়ে যান মূল দলেও। এর পরের গল্পটা কেবল তার উত্থানের। দারুণ খেলে নজরে পড়েন ইউরোপের ক্লাবগুলোর। পরের বছর ২০০৬ সালেই সুযোগ মেলে ডাচ ক্লাব এফসি গ্রোনিঙ্গেনে। সেখানেও অব্যাহত থাকে তার সাফল্যযাত্রা, পরের বছরই যোগ দেন নেদারল্যান্ডসের শীর্ষ ক্লাবগুলোর অন্যতম আয়াক্সে।
সেখানে তিন বছরের কিছু বেশি সময় কাটান সুয়ারেজ। এরপর ২০১১ সালে তার জন্য খুলে যায় ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুলের দরজা। অল রেডদের হয়েই মূলত নিজের প্রকৃত জাত চেনান তিনি। স্ট্রাইকার হিসেবে তুখোড় ফিনিশিংতো ছিলই, সঙ্গে প্লেমেকিং দক্ষতা অনন্য করে তোলে তাকে। এমন ফরোয়ার্ডকে দলে না ভিড়িয়ে থাকনে পারেনি বার্সেলোনা, ২০১৪ সালে ব্লগ্রানা শিবিরে নাম লেখান সুয়ারেজ। এরপর বাকিটা ইতিহাস, লিওনেল মেসি ও নেইমার জুনিয়রের সঙ্গে তার সংমিশ্রণে তৈরি হয় সেই দশকের অন্যতম ভয়ংকর আক্রমণভাগ এমএসএন (মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার)।
জাতীয় দলের হয়ে কখনোই মলিন ছিল না সুয়ারেজের পরিসংখ্যান। ১৩৪ ম্যাচ খেলে নামের পাশে আছে ৬৮টি গোল। এখন আর নেই অতীতের ধার। তবুও ডারউইন নুনেজদের তরুণ রক্তের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার মিশেলে হতে পারে দারুণ কিছু। সঙ্গে মিডফিল্ডে ফেদ্রিকো ভালভার্দের উপস্থিতিতে এবারও আশায় বুক বাঁধছে উরুগুয়ানরা। ক্লাব ফুটবলে অর্জনের খাতাটা বেশ সমৃদ্ধ হলেও জাতীয় দলের হয়ে এক কোপা আমেরিকা ছাড়া আর কিছুই নেই সুয়ারেজের ঝুলিতে।
২০২৬ বিশ্বকাপে সুয়ারেজের বয়স হবে ৩৯, ফলে সেই আসরে তিনি খেলবেন-নেই এমন কোন নিশ্চয়তা। এদিকে ১৯৩০ ও ১৯৫০ এর পর আর কখনই বিশ্বমঞ্চে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনি উরুগুয়ে। ফলে ২০২২ সালে দেশকে তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিতে যে চেষ্টার কমতি রাখবেন না হাজারো বিতর্কের নায়ক সুয়ারেজ, সেটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
Comments