আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৩

অনিশ্চয়তার আগল ভেঙে লাবুশেনের ‘মিরাকল’

গত সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন পর্যন্ত যাত্রায় কীভাবে লাবুশেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন, নিজেও জানেন না!

অনিশ্চয়তার আগল ভেঙে লাবুশেনের ‘মিরাকল’

মারনাস লাবুশেন
ছবি: রয়টার্স

আহমেদাবাদে সতীর্থরা শিরোপা উদযাপনে মেতে উঠেছেন। দূরে কোথাও বসে তা দেখতে হচ্ছে মারনাস লাবুশেনকে। এমনটা হতেই পারত। লাবুশেনের দর্শক বনে বিশ্বকাপ দেখার ভালো সম্ভাবনাই ছিল। তবে শেষমেশ নভেম্বরের ১৯ তারিখ অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বজয়ী জুটির একটি নামই তার। গত সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন পর্যন্ত যাত্রায় কীভাবে লাবুশেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন, নিজেও জানেন না! সময়টাকে তিনিই এক শব্দে সুন্দর করে বর্ণনা করে দিলেন— 'মিরাকল'!

অনিশ্চয়তার চাদরে থেকেই 'মিরাকলে'র সময়টা লাবুশেনকে পার করতে হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে খেলবেন, সেটা নিয়েও তো নিশ্চিত হতে পারছিলেন না ম্যাচের আগের রাতেও। রোববার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সেই অভিজ্ঞতা জানান লাবুশেন। তার মুখেই শুনুন, 'গতকাল (শনিবার) রাতেও একাদশ ঘোষণা করা হয়নি রাত দশটা পর্যন্ত। আমি ভেবেছি, কোচেরা মাঠে গিয়েছেন, শিশির থাকতে পারে, আমি বাদ পড়ে যেতে পারি।'

ফাইনালের আগে অস্ট্রেলিয়ার একাদশ নিয়ে যে একটা প্রশ্ন ছিল, সেটা লাবুশেন নাকি মার্কাস স্টয়নিস? সুযোগ পেয়ে ফাইনালে নেমে এরপর লাবুশেন খেলেন ১১০ বলে অপরাজিত ৫৮ রানের সময়োপযোগী ইনিংস। ট্রাভিস হেডের সঙ্গে তিনি গড়েন ১৯২ রানের জুটি। সেই হেডের যখন ইনজুরি থেকে লিগ পর্বের ষষ্ঠ ম্যাচে ফেরা নিশ্চিত হয়েছিল, তখন লাবুশেনের জায়গাই পড়ে গিয়েছিল হুমকির মুখে। তবে স্টয়নিস হালকা ইনজুরিতে থাকায় একাদশে জায়গা ধরে রাখেন লাবুশেন।

বিশ্বকাপের প্রথম অর্ধেও হেডের অনুপস্থিতিতে সুযোগ মেলে লাবুশেনের। বাদ পড়ে যেতে পারেন, সে চিন্তা মাথার ওপর থেকেছে এরপর সব সময়ই। শেষ পর্যন্ত টানা ফাইনাল পর্যন্তই খেলে ফেলেন।

গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে যখন অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের প্রাথমিক স্কোয়াড ঘোষণা করে, সেখানে ছিল না লাবুশেনের নাম। তাই সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ওয়ানডে সিরিজেও থাকেননি স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু সিরিজ শুরুর আগে ইনজুরিতে পড়ে যান স্টিভেন স্মিথ। ডাক পড়ে যায় লাবুশেনের।

প্রথম ম্যাচে একাদশে সুযোগ পাননি। ম্যাচের মাঝেই কাগিসো রাবাদার বলে মাথায় আঘাত পান ক্যামেরন গ্রিন। কনকাশন বদলি কে? লাবুশেন! ২২৩ রানের লক্ষ্যে নেমে অস্ট্রেলিয়া ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে ১১৩ রানেই। সেখান থেকেই পরে তাদের জেতান লাবুশেন। ৮০ রানের ইনিংস খেলে। একাদশে জায়গা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও ওই ম্যাচ থেকে এরপর অস্ট্রেলিয়া মোট যে ১৯ ম্যাচ খেলেছে, সবকটিতেই নিজের নাম দেখতে পান লাবুশেন।

ফাইনাল শেষে চোখের জলে লাবুশেন বলে যান অনিশ্চয়তার আগল ভাঙার গল্প, 'আমি জানি, আপনারা জানেন, আমি বিশ্বাসী মানুষ, ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। যেভাবে সব কিছু ঘটল, এটা অবিশ্বাস্য আমার কাছে। এটা শুধু চমৎকারই বলতে পারি। আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কতবার যে ভেবেছি আমি শেষ... তো আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি আমাকে দলে রাখার জন্য। আমার কাছে আসলে বেশি শব্দ নেই ব্যাখা করার জন্য। তিন মাস আগে, দক্ষিণ আফ্রিকায় পর্যন্ত ছিলাম না ওয়ানডে দলে, সেখান থেকে টানা ১৯ ম্যাচ খেলা, এটা সত্যিই "মিরাকল"। আমি জানিনা কীভাবে, জানতে পারবও না। আমি সেটার জন্য ধন্যবাদ জানাই ঈশ্বরকে।'

সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে 'মিরাকল' যাত্রা শুরুর আগে অজিদের জার্সিতে ৩০ ওয়ানডে খেলেছিলেন। সেখানে ২৮ ইনিংসে প্রায় ৩১ গড়ে ৮৪৭ রানের বেশি করতে পারেননি লাবুশেন। তার মলিন ওয়ানডে ফর্মের সঙ্গে ওই ১৮ সদস্যের প্রাথমিক স্কোয়াড থেকে বাদ দেওয়ার আরেকটা কারণও জানিয়েছিলেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। অজিরা যে আগ্রাসী ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলুড়ে দল গড়তে চেয়েছে, সেখানে ক্লাসিক ঘরানার লাবুশেনের খেলা মানানসই নয়।

কামিন্সের বক্তব্য এমন, 'আমরা আসলে এই বিশ্বকাপে সাহসী ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। আমরা এমন দল হতে চেয়েছি, যে দল ৪০০ করতে পারবে। দল সাজানোতেও আপনারা তা দেখতে পাবেন, যেভাবে আমরা ট্রাভিস (হেড), (ডেভিড) ওয়ার্নার ও এরপর তিনে (মিচেল) মার্শকে রেখেছি। আমরা বেশ আগ্রাসী হতে চেয়েছি এবং এরপর দুয়েকজন অলরাউন্ডার আছে, যারা অবশ্যই আগ্রাসী এবং ইনিংস শেষ করবে। আমরা এভাবে ব্যর্থ হতেও রাজী ছিলাম। কিন্তু এরপর মারনাস (লাবুশেন) তার ক্লাস দেখিয়েছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় আপনাকে তাকে রাখতেই হতো। সে দুর্দান্ত ছিল এবং সে ভিন্ন স্টাইলে খেলেছিল তার ওডিআই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের তুলনায়।'

ফাইনালে ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলায় সেই ঠাণ্ডা মাথার লাবুশেনের খেলারই বড্ড প্রয়োজন পড়ে যায় ফাইনালে। হেডও বলেন ম্যাচশেষে, 'আমি শুরুতে নার্ভাস ছিলাম। তবে যেভাবে লাবুশেন চাপ শুষে নেয় তা দারুণ ছিল।'

ওই কনকাশন বদলি হয়ে যে-ই সুযোগ পান লাবুশেন, একেবারে মুঠোয় ভরে সুযোগটা নেন। তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের মোড়ই বদলে গেল। তার হাতে যা করার ছিল, ব্যাট হাতে তাই করে রাখলেন।

ভারত বিশ্বকাপের আগে নিশ্চিত হয়, চোটে পড়ে অ্যাস্টন অ্যাগার থাকছেন না। লাবুশেনের ভারত বিশ্বকাপে প্রবেশাধিকার মিলে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের সেই ম্যাচ থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ১৮ বার ব্যাটিং করে প্রায় ৪৯ গড়ে তিনি রান করেছেন ৭৮৩। লাবুশেন এখন বিশ্বকাপজয়ী, 'যা অর্জন করলাম আমরা, এটা অবিশ্বাস্য। এটা আমার জীবনের সেরা অর্জন।'

সেরা অর্জন তো এমনিতেই মনে রাখবেন লাবুশেন। কিন্ত যেভাবে সেই অর্জনের দেখা পেলেন, তাতে তো আরও বেশিই মনে রাখবেন। অবিশ্বাস চোখেমুখে নিয়ে হয়তো তখন লাবুশেনের ওই একটা শব্দই মনে পড়বে, 'মিরাকল'!

Comments

The Daily Star  | English

Tajia procession marks holy Ashura in Dhaka amid tight security

Crowds began gathering at the site from the early hours, with many attending alongside their families and children

7m ago