‘চাঁদনী পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়’
হুমায়ূন আহমেদ “আমার ছেলেবেলা” বইয়ে লিখেছেন – “আমার শৈশবটা কেটে গেছে দুঃখ মেশানো আনন্দে-আনন্দে। যতই দিন যাচ্ছে সেই আনন্দের পরিমাণ কমে আসছে। আমি জানি, একসময় আমার সমস্ত পৃথিবী দুঃখময় হয়ে উঠবে। তখন যাত্রা করব অন্য ভুবনে, যেখানে যাবতীয় আনন্দ বেদনার জন্ম।” ২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি যখন তাঁর কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে তখন মনে হয়েছিল একবার যদি তাঁর কাছে জানতে পারতাম, “সত্যিই কি জীবন দুঃখময় হয়ে গেছে যে আপনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাচ্ছেন। এতো মানুষের ভালবাসা কি আপনার দুঃখ কমাতে পারে নি?”
মৃত্যুর সময় হলে চলে যেতেই হবে। এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা করার উপায় থাকে না। “ঈশ্বর যদি কাউকে মারতে চান তাহলে কি তার কোনো আয়োজন করার প্রয়োজন আছে? তাহলে মরতে কিসের ভয়, একবারই তো মরতে হবে।” তাঁর এ কথাটি যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যখন মারা যায় তখন তা শুধুই প্রকৃতির নিয়মে আরেকটি মৃত্যুর ঘটনা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মত মানুষেরা যখন চলে যান তখন তা হয়ে ওঠে ভিন্ন। কোটি ভক্তের অশ্রুর সঙ্গে সাহিত্যের অঙ্গনেও তা একটু ধাক্কা দেয়। সময়ের সাথে সাথে শোক অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন সবাই। শুকিয়েও গেছে অনেক ভক্তের চোখের জল। সত্যি হয়েছে “জনম জনম”-এ তাঁর লেখা, “কাঁদারও হয়তো সীমা আছে। সীমা অতিক্রম করে কেও কাঁদতে পারে না।”
মানুষের মন পড়ার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে এই লেখকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর। আজ, ১৯ জুলাই, এই কীর্তিমান লেখকের ৫ম মৃত্যু বার্ষিকী। শুধু লেখক বললে অবশ্য ভুল হবে। কেননা, তিনি একাধারে যেমন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, নাট্যকার, গীতিকার তেমনি চলচ্চিত্র ও টিভি নাটক নির্মাতা হিসাবে রেখেছেন তাঁর অপরিসীম মেধার স্বাক্ষর।
সত্তর দশকের শেষ থেকে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা। তাঁর লেখার ভেতর এক অদ্ভুত ধরনের জাদু রয়েছে। পড়তে গেলে অভিভূত হয়ে কখনও কখনও নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে হয় গল্পের চরিত্রে। অনেক রকম আনন্দ-দুঃখ, ভালোবাসার কথা সাজিয়ে, পাঠকদের ভুলিয়ে রাখতে পারে তাঁর লেখাগুলো। এগুলো এতো বেশি সহজ আর সাধারণ যে তা একবার পড়তে শুরু করলে নিয়মিত পাঠক না হয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। সত্যিই বলেছিলেন তিনি, “সাধারণ হওয়াটা একটা অসাধারণ বিষয়, সবাই সাধারণ হতে পারেন না।”
বাংলা সাহিত্যের এই জাদুকর ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে” প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রকাশ করেন। এরপর, তিনি রচনা করেছেন প্রায় তিন শতাধিক বই। তাঁর লেখা প্রায় প্রতিটি বইয়ের মধ্যেই পাওয়া যায় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এক চিরচেনা চিত্র। আমাদের জীবনের চারপাশের ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো তিনি এতো সুন্দরভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন যে পড়লেই মনে হয়, আরে এটি তো আমাদেরই গল্প।
হুমায়ূন আহমেদের কিছু উক্তি উল্লেখ করতে চাই:
“মানুষ কখনো অন্ধকারে হাসে না। কাঁদতে হয় অন্ধকারে, হাসতে হয় আলোয়।”
“একটা মেয়ের কেমন বিয়ে হবে কেমন বর হবে তা নির্ভর করে মেয়েটা দেখতে কেমন। মেয়েটা বুদ্ধিমতী কি-না, পড়াশোনায় কেমন, তার মনটা কেমন এইসব দেখা হবে না।”
“সুন্দরী মেয়েরা খুব অহংকারী হয়। তারা সব সময় তাদের চারপাশে একদল মুগ্ধ পুরুষ দেখতে চায়।”
“একটা বয়সে প্রতিটি যুবক কিছু দিনের জন্য কার্ল মার্কস হয়ে যায়। নিপীড়িত অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করতে হবে - এই ভূত মাথায় ভর করে। এইটা হলো এক ধরণের ভাইরাস সংক্রমণ। ভাইরাসের কোনো ওষুধ নেই। এই অসুখেরও কোনো ওষুধ নেই। কিছু দিন পর আপনা আপনি ভাইরাস মারা যায়। রোগী সেরে ওঠে।”
“সংসার কোন আনন্দের ব্যাপার না, ভাইজান! খুবই নিরানন্দের ব্যাপার। সংসার মানেই দ্বীপান্তর।”
“সমুদ্রের জীবনে যেমন জোয়ার-ভাটা আছে, মানুষের জীবনেও আছে। মানুষের সঙ্গে এই জায়গাতেই সমুদ্রের মিল।”
“বাবা-মা’র প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভালো। খেলনা যখন হাসে, বাবা-মা হাসে। খেলনা যখন কাঁদে বাবা-মা’র মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।”
“মাঝে মাঝে তুচ্ছ বিষয় চোরকাঁটার মত মনে লেগে থাকে… ব্যথা দেয় না, অস্বস্তি দেয়…।”
“মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোই ধরণীর আসল রূপ দেখতে পায়।”
“গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয় দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হন। কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল। দুজন এক সঙ্গে কখনো পুতুল হয় না। কে পুতুল হবে আর কে হবে সূত্রধর তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতার উপর। মানসিক ক্ষমতা যার বেশী তার হাতেই পুতুলের সুতা।”
হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, কিছু গ্রন্থ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর সৃষ্ট হিমু এবং মিসির আলি চরিত্রগুলি এদেশের যুবকশ্রেণীকে উদ্বেলিত করেছে গভীরভাবে। অনেক যুবককেই দেখা যায় যারা রয়েছে হিমু হওয়ার প্রচেষ্টায়। তাঁর নির্মিত নাটক এবং চলচ্চিত্রগুলো পেয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “প্রতি মানুষের জীবনে কষ্ট আছে, শুধু তা প্রকাশ করার পদ্ধতি ভিন্ন, নির্বোধরা প্রকাশ করে চোখের পানি দিয়ে, আর বুদ্ধিমানরা প্রকাশ করে মৃদু হাসি দিয়ে।” সে জন্যই হয়তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয়ে আমরা যখন তটস্থ থাকি তখন তিনি বলতে পারেন:
“পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে।
শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে।
সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না।
কোনো মানে হয়..”
Comments