টুইটারের নতুন সিইও কে এই লিন্ডা ইয়াকারিনো

ইতালীয়-আমেরিকান পরিবারে জন্ম লিন্ডার। তার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা।
টুইটারের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লিন্ডা ইয়াকারিনো। ছবি: এএফপি

টুইটার কেনার ৬ মাস পর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নাম ঘোষণা করেছেন ইলন মাস্ক। মার্কিন বহুজাতিক গণমাধ্যম এবং বিনোদন সংস্থা এনবিসিইউনিভার্সালের সাবেক প্রধান বিজ্ঞাপনী কর্মকর্তা লিন্ডা ইয়াকারিনো হতে যাচ্ছেন টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

মাস্ক বলেছেন, আগামী ৬ সপ্তাহের মধ্যে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন লিন্ডা। টুইটারের আয় বাড়ানোই হবে লিন্ডার প্রাথমিক কাজ।

প্রায় ৬ মাস আগে রেকর্ড ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে টুইটার কিনে নেন ইলন মাস্ক। তার নিয়ন্ত্রণে আসার পর প্রতিষ্ঠানটিতে একের পর এক সমস্যা লেগেই আছে। মালিকানা হাতে পেয়েই টুইটারের অধিকাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করেন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিতে দ্রুত অনেক পরিবর্তনও নিয়ে আসেন তিনি, যেগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র বিতর্ক হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। টুইটার নিয়ে মাস্কের বিভিন্ন নীতিরও প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

তবে লিন্ডার নিয়োগের পরও মাস্ক প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন।

টুইটারে লিন্ডার নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে মাস্ক বলেন, 'এই প্ল্যাটফর্মটিকে এক্স- এ রূপান্তর করতে লিন্ডার সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।' মাস্ক দীর্ঘদিন ধরেই চীনের উইচ্যাটের মতো 'এক্স অ্যাপ' চালু করার কথা বলছেন। এটি হবে একটি সুপারঅ্যাপ, যার সাহায্যে সব ধরণের সেবা পাওয়া যাবে।

টুইটারের দায়িত্ব একজন সিইওর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনেক দিন ধরেই চাপের মুখে ছিলেন মাস্ক। মাস্কের অন্য ২টি প্রতিষ্ঠান টেসলা এবং স্পেসএক্স এর বিনিয়োগকারীরা চাইছিলেন মাস্ক টুইটারে বেশি সময় না দিয়ে এসব লাভজনক ও সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানে বেশি সময় দিক।

ফরচুন ৫০০ টেক কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের কম কোম্পানির প্রধান ব্যক্তি নারী। প্রথম সারির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হয়ে লিন্ডা তাই অনুসরণীয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। 

কে এই লিন্ডা?

ইতালীয়-আমেরিকান পরিবারে জন্ম লিন্ডার। তার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা।

পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি (পেন স্টেট) থেকে পড়াশোনা শেষ করে মার্কিন মাল্টিমিডিয়া কোম্পানি টার্নার এন্টারটেইনমেন্টে যোগ দেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর কাজ করার পর এনবিসিইউনিভার্সালে যোগ দেন। তার অধীনে প্রায় ২ হাজার কর্মী কাজ করতো। এনবিসিইউনিভার্সালের স্ট্রিমিং সার্ভিস চালুর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

এনসিবিসিইউনিভার্সালে থাকার সময় বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে কোলাবোরেশন, প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টের বিভিন্ন সুযোগ খুঁজে বের করা, বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে টেলভিশন শো'র বাইরেও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দিতে রাজি করানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। অ্যাপল নিউজ, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইউটিউবের মতো নতুন নতুন মিডিয়াগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করেছেন তিনি। ২০০৫ সালে এক প্রকাশনায় তাকে অত্যন্ত ব্যস্ত, বিবাহিত এবং ১৩ ও ৯ বছর বয়সী ২ সন্তানের মা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

সেই সময় এক সাক্ষাৎকালে তিনি বলেছিলেন, 'আমার আসলে কোনো শখ নেই।'

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লিন্ডার চাকরি জীবন ও কাজ পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজনেস ইনসাইডারের সাংবাদিক ক্লেয়ার অ্যাটকিনসন। তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনী খাতে লিন্ডার দক্ষতা টুইটারের কাজে আসবে। মাস্কের অধীনে টুইটারের বিজ্ঞাপনী আয়ে ধস নেমেছে।

অ্যাটকিনসন বলেন, 'যদি বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকে টুইটারের, তাহলে লিন্ডা সেখান থেকেই তার কাজ শুরু করতে পারে। এই কাজের জন্য তিনিই যোগ্য ব্যক্তি। টুইটারের জন্য ইলন মাস্কের যে রকম মানুষ দরকার, লিন্ডা তেমনই একজন।'

ব্যতিক্রমী নেগোসিয়েশন স্টাইলের কারণে প্রযুক্তি দুনিয়ায় তিনি 'ভেলভেট হ্যামার' নামে পরিচিত।

দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে লিন্ডাকে। দীর্ঘদিন ধরেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সংগ্রাম করছে টুইটার। এই প্ল্যাটফর্মে ভুয়া তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো বন্ধে তিনি কী কী উদ্যোগ নেন, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকবে সবার।

মাস্ক যখন গত বছর টুইটারের জন্য তার পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি বিজ্ঞাপনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমাতে চান এবং কনটেন্ট মডারেশন পদ্ধতির পরিবর্তন চান।

এছাড়া টুইটারে তিনি পেমেন্টস, এনক্রিপ্টেড মেসেজিং, ফোন কলসহ নানা সুবিধা যুক্ত করে এটি 'এক্স' নামে এমন একটি একক প্ল্যাটফর্মে পরিণত করতে চান, যেখানে সব ধরণের সুবিধা পাওয়া যাবে। 

কিন্তু টুইটারের মালিকানা হাতে পেয়েই তিনি কয়েক হাজার কর্মী ছাঁটাই করেন। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের মধ্যে টুইটারের বিদ্বেষ ও ভুয়া তথ্য ছড়ানো যারা নিয়ন্ত্রণ করতো, তারাও ছিলেন। শুধু পরিচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্লু টিক দেওয়ার যে নীতি ছিল টুইটারের, সেটিও পরিবর্তন করেন মাস্ক। বর্তমানে মাসে ৮ ডলারের বিনিময়ে যে কেউ টুইটারের ব্লু টিক নিতে পারবেন, এমন নিয়ম চালু করেছেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে ভেরিফায়েড একাউন্ট থেকে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

মাস্কের অনেক পরিবর্তন বিজ্ঞাপনদাতারা ভালোভাবে নেয়নি। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান টুইটারে বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছে। সম্প্রতি মাস্ক নিজেও স্বীকার করেছন যে টুইটারের বিজ্ঞাপনী আয়ে ধস নেমেছে, তবে তিনি দাবি করেছেন বিজ্ঞাপনদাতারা আবার ফিরে আসছে।

গত মাসে এক অ্যাডভার্টাইজিং সম্মেলনে লিন্ডা মাস্কের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে বিজ্ঞাপনদাতাদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক কী করছেন, সেটি জানার জন্য মাস্ককে বারবার চাপ দিচ্ছিলেন তিনি।

লিন্ডা বলেন, 'এই কক্ষে যারা আছেন, তারাই আপনার লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার রাস্তা। কিন্তু এই কক্ষে অনেক সন্দেহও আছে।'

লিন্ডার নিয়োগ নিয়ে অবশ্য সামাজিক মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তার রাজনৈতিক আদর্শের খোঁজ করছেন। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে লিন্ডা মূলত কনজারভেটিভ ঘরানার।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে কাজ করার সময় পোপ ফ্রান্সিসকে দিয়ে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন তিনি, যেটি অনেকে ডানপন্থীরা ভালোভাবে নেননি।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে তিনি হোয়াইট হাউজের স্পোর্টস, ফিটনেস অ্যান্ড নিউট্রিশন কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ফলে তার রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে বামপন্থীদের আপত্তি আছে।

মাস্ক স্পেসেএক্স এবং টেসলার বিভিন্ন উচ্চপদে নারীদের নিয়োগ দিয়েছেন। তবে বস হিসেবে তিনি অনেক অনিশ্চিত ও ডিমান্ডিং- এমন দুর্নাম আছে মাস্কের।

তার নিয়োগ নিয়ে লিন্ডা এখনো কোনো মন্তব্য করেননি।

টুইটার পরিচালনায় লিন্ডা ও মাস্কের মিথস্ক্রিয়া কীভাবে কাজ করে, তা দেখতে সবাই মুখিয়ে আছেন।

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments