ঢাবি শিক্ষার্থীদের ‘অভিভাবকের’ কাণ্ড

হল প্রভোস্টের কাছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ শিক্ষার্থী পুলিশের কাছে নিরপরাধ
কামরুল হাসান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থীকে 'রাষ্ট্রবিরোধী' এবং 'জঙ্গি সম্পৃক্ততা'র 'প্রাথমিক প্রমাণ' পেয়েছেন— এমন দাবি করে গত বৃহস্পতিবার থানায় সোপর্দ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ বিল্লাল হোসেন।

ঘটনার দিন রাতে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে তিনি দাবি করেন, কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে নিয়ে তিনি অভিযোগটি তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে প্রমাণও পেয়েছেন যে ওই শিক্ষার্থী 'রাষ্ট্রবিরোধী'। এর ডিজিটাল প্রমাণ তাদের কাছে আছে।

ওই শিক্ষার্থীকে তার কাছে অপরাধী মনে হওয়ায় প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে রাতে হল থেকে পুলিশের কাছে তিনি সোপর্দ করেছেন।

প্রভোস্টের কাছে যে শিক্ষার্থীকে 'রাষ্ট্রবিরোধী' ও 'জঙ্গি' মনে হয়েছে, সেই শিক্ষার্থী পুলিশের কাছে নিরপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় পরের দিন (১৯ আগস্ট) থানা থেকে মুক্তি পেয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হল প্রভোস্টের এমন আচরণকে দায়িত্বশীল আচরণ মনে করছেন না। তারা সমালোচনা করে বলছেন, অধিক তদন্ত না করেই একজন শিক্ষার্থীকে সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বানিয়ে দেওয়া মোটেই দায়িত্বশীল আচরণ হয়নি। হয়তো দলান্ধতার কারণেই তিনি এমনটি করেছেন।

তারা বলছেন, 'হল প্রভোস্ট ছাত্রলীগের মতো আচরণ করেছেন। প্রভোস্টের এমন আচরণে জন্য শিক্ষার্থীকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।'

এর জন্য সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ বিল্লাল হোসেনের শাস্তি দাবি করেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামূল হক ভূইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি মনে করি, অভিযোগটি আরেকটু গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন ছিল৷ হয়তো হলের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই শিক্ষার্থীকে থানায় সোপর্দ করা হলো৷ পুলিশ যেহেতু বলেছে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, সেহেতু প্রভোস্টদেরও আরও বেশি দায়িত্ব নিয়েই কাজ করতে হবে৷ যখন কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসবে, তখন আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হবে না৷ এ ব্যাপারে হল প্রভোস্টকে আরও সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল৷'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিনি (প্রভোস্ট) একজন প্রশাসক না শুধু, একজন শিক্ষকও। হলের সব শিক্ষার্থীর অভিভাবক তিনি। একজন বাবা তার সন্তানকে পুলিশে দিতে পারেন, কিন্তু শিক্ষক তার ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারেন না। যদি কোনো শিক্ষার্থী অপরাধমূলক কাজে জড়িত বলে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ থাকে, তাহলে তিনি পুলিশকে অবহিত করতে পারেন। কিন্তু পুলিশের হাতে শিক্ষার্থীকে তুলে দিতে পারেন না।'

তিনি আরও বলেন, 'কোনো শিক্ষার্থী যদি ভুল কাজ করেও থাকেন, তাহলে একজন শিক্ষকের কাজ হচ্ছে তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীকে সঠিক পথে নিয়ে আসা।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ ভালোভাবে তদন্ত না করে থানায় সোপর্দ করা শিক্ষকের কাজ হতে পারে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, 'শিক্ষার্থী যদি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া কথা। কিন্তু প্রশাসনের এ ধরনের আচরণ শিক্ষার্থীদের জন্য হয়রানি ছাড়া আর কিছু নয়। এ রকম হয়রানিমূলক আচরণ শিক্ষার্থীদের মুক্তভাবে কথা বলার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে। ছাত্রলীগের গেস্টরুম সংস্কৃতির জন্য শিক্ষার্থীরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারেন না। এখন যদি প্রশাসনও এভাবে হয়রানি করে, তাহলে ভিন্নমত আর থাকবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'হলের শিক্ষার্থীরা প্রভোস্টের কাছে সন্তানতুল্য। সেই জায়গা থেকে তিনি এ ধরনের কাজ কখনও করতে পারেন না। হলের মধ্যে কীভাবে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং ভিন্নমত প্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায় সেটা প্রভোস্টের দায়িত্ব। কিন্তু তিনি ছাত্রলীগের মতো ভূমিকা পালন করেছেন। এর জন্য প্রভোস্টের বিচার হওয়া উচিত।'

ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ বিল্লাল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তো সবকিছু যাচাই করতে পারবো না। অভিযোগটি খতিয়ে দেখার জন্য ওই শিক্ষার্থীকে থানায় দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ ছিল— রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গি সম্পৃক্ততা। অভিযোগগুলো আমাদের দৃষ্টিতে ছিল রাষ্ট্রবিরোধী। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বললো যে এটা ফৌজদারি মামলায় নেওয়া যায় না।'

ঘটনাটি হল প্রভোস্ট না দেখে পুলিশ পর্যন্ত কেন নিলেন জানতে চাইলে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ঘটনাটি কেন হল কর্তৃপক্ষ দেখতে পারলো না?— প্রশ্নের উত্তর আমি হল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইবো। হল প্রশাসনও আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমও আছে। এই দুটির সমন্বয়ে কেন করতে পারলো না, তা আমি জানার চেষ্টা করবো।'

তিনি আরও বলেন, 'হল প্রভোস্ট আমাকে জানিয়েছেন যে অনেক সময় ছোট ঘটনা বড় হয়ে গেলে শিক্ষার্থীরা আরও ভোগান্তিতে পড়েন। সেই কারণে হয়তো থানায় সোপর্দ করেছেন। অনেক সময় সাইবার সম্পর্কিত তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিতে হয়। কিন্তু এগুলো যদি গুজব আকারে কেউ ছড়িয়ে দেয়, তখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেয়। আমাদের কোনো শিক্ষার্থী যেন বিপদে না পড়েন এবং হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়টি আমি সব সময় গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করি।'

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

3h ago