ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে বন্দী নোবিপ্রবি

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে দাপ্তরিক নথির ডুপ্লিকেট কপি তৈরি, সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণী পরিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, প্রতারণা এবং নারী সহকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এত অভিযোগ সত্ত্বেও জসিম উদ্দিনকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের তোড়জোড় চলছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ। তাদের ভাষ্য, জসিম উদ্দিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, জসিম উদ্দিন তার কর্মজীবনের শুরুতে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে যোগ দেন। সেখানে ২০১০ সালের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ বছর ৩ মাস ২৪ দিন চাকরি করেন তিনি।

এরপর ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী রেজিষ্ট্রার পদে কাজ করেন জসিম উদ্দিন। ২ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকরির অভিজ্ঞতা দাঁড়ায় ৮ বছর ২ মাস ৪ দিনের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি অনুসারে ডেপুটি রেজিষ্ট্রার পদে নিয়োগ পেতে কমপক্ষে ১০ বছর চাকরি করার অভিজ্ঞতা থাকার বিধান আছেন। কিন্তু ৮ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েই জসিম উদ্দিন ২০১২ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিষ্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান।

এই ধারাবাহিকতায় গত বছর নোবিপ্রবির রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা সাবেক উপ-উপাচার্য মো. আবুল হোসেন অবসরে গেলে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হন জসিম উদ্দিন।

নোবিপ্রবির শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ডেপুটি রেজিষ্ট্রারে পদে থাকার সময় থেকেই জসিম উদ্দিন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি শুরু করেন। এর পাশাপাশি তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অশোভন আচরণের শিকার হন অনেকে।

ডেপুটি রেজিস্ট্রার থাকাকালীন জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ১৬ জুন অশালীন আচরণের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন এক নারী। একই বছর আরও ২ দফায় তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য তৎকালীন রেজিষ্ট্রার অধ্যাপক মো. মমিনুল হক ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

জসিম উদ্দিনের স্বেচ্ছাচারিতার আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো কেমিস্ট্রি ও মোলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুবোধ সরকারের ভাষ্যে। তিনি জানান, গত বছরের নভেম্বরে তাকে বিধিবহির্ভূতভাবে চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তনিমা সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পদ ফিরে পেতে উচ্চ আদালতের শরণ নেন তিনি। পরে আদালত ডিসেম্বর মাসে  তাকে চেয়ারম্যান পদে পুনর্বহালের আদেশ দেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জসিম উদ্দিন।

নোবিপ্রবির শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এক কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জসিম উদ্দিনের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। একই স্মারক নম্বর ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন চিঠি তৈরি করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগ ও অনিয়মের সব নথি দ্য ডেইলি স্টারের হাতে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধি অনুসারে ডেপুটি রেজিষ্ট্রার পদের জন্য সহকারী রেজিষ্ট্রার পদে কমপক্ষে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু ১ বছর ১০ মাসের অভিজ্ঞতা নিয়েই জসিম উদ্দিন তৎকালীন উপাচার্যকে 'ম্যানেজ' করে ডেপুটি রেজিষ্ট্রারের পদ হাতিয়ে নেন। পরবর্তীতে সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জসিম উদ্দিনের নিয়মবহির্ভূত নিয়োগের বিষয়টি ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পদাবনতিসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

এসবের বাইরে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা আদায়, প্রতারণা ও হুমকি প্রদর্শনের মতো অভিযোগও আছে।

এ বিষয়ে মাইজদি শহরের ব্যবসায়ী মো. আরিফুর রহমানের অভিযোগ, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০১৩ সালে ১০ লাখ টাকা নেন জসিম উদ্দিন।

আরিফুর রহমান বলেন, 'জসিম উদ্দিন বিভিন্ন প্রভাবশালী লোকজনের পরিচয় দিয়ে এমন অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জসিম উদ্দিন বিভিন্ন সময় নিজেকে সাবেক এক সচিবের ঘনিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে আসছেন। শিক্ষকরাও তার কাছে জিম্মি। অথচ এমন একজন মানুষকে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিতে পরিকল্পনা করছে প্রশাসন।'

আরও কয়েকজন শিক্ষকের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হওয়ার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্ব- কোনোটিই নেই জসিম উদ্দিনের। তিনি ভালো আচরণ জানেন না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। আমি দুর্নীতি করি না। কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে।'

নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে তার বক্তব্য, 'আমিতো নিয়োগ শাখায় কাজ করি না। সুতরাং এমন কিছু করার প্রশ্নই ওঠে না।'

সার্বিক বিষয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. দিদারুল আলম বলেন, 'তার (জসিম উদ্দিন) ব্যাপারে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। যারা তাকে পছন্দ করে না, তারাই এসব রটাচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

What are we building after dismantling the AL regime?

Democracy does not seem to be our focus today. Because if it were, then shouldn’t we have been talking about elections more?

11h ago