ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘ভাই কি এই ক্যাম্পাসের’ প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয় ছিনতাই

‘আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাবির শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করি। অথচ, সেই শিক্ষার্থীরা আমার গায়ে হাত তুলতে একটুও দ্বিধা করলো না! ওরা কবে থেকে এমন ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধী হয়ে গেল?’

ঢাকায় তখন রাত ১১টা।

এক বিবাহিত দম্পতি তাদের নাজিমউদ্দিন রোডের বাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় মামার বাড়িতে বেড়াতে যান। তারা ঢাবির শহীদ মিনার চত্বরে পৌঁছালে ঢাবি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল তাদের বাধা দেয়, নির্দয়ভাবে মারধর করে, ২২ হাজার টাকা ও এটিএম কার্ড ছিনতাই করে চলে যায়।

এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীর মামা ঢাবির মাস্টারদা সূর্য সেন হলের প্রিন্সিপাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আব্দুল মোতালেব বাদী হয়ে ফাহিম তাজওয়ার জয় ও সাজিদ আহমেদসহ অজ্ঞাতনামা ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাবির শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করি। অথচ, সেই শিক্ষার্থীরা আমার গায়ে হাত তুলতে একটুও দ্বিধা করলো না! ওরা কবে থেকে এমন ঠাণ্ডা মাথার অপরাধী হয়ে গেল?

ঢাবির মাস্টারদা সূর্য সেন হলের প্রিন্সিপাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আব্দুল মোতালেব

মামলার এজাহারে বলা হয়, ফাহিম ঢাবির ইতিহাস বিভাগে (সেশন ২০২১-২২) এবং সাজিদ ঢাবির তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করেন।

তারা ২ জনই মাস্টারদা সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের কর্মী বলে হল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে আমার ভাগ্নি ও তার স্বামীকে লাঞ্ছিত ও হয়রানি করে ছিনতাই করা হয়। ছিনতাইকারীরা ২২ হাজার টাকা ও একটি এটিএম কার্ড নিয়ে গেছে। তাদেরকে বাঁচাতে আমি ও আমার ছেলে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে তারা আমাদেরকেও মারধর করে।

মোতালেব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাবির শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করি। অথচ, সেই শিক্ষার্থীরা আমার গায়ে হাত তুলতে একটুও দ্বিধা করলো না! ওরা কবে থেকে এমন ঠাণ্ডা মাথায় অপরাধী হয়ে গেল?'

এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কেবল গত ১ মাসে শাহবাগ থানা ও গণমাধ্যমে এ ধরনের অনেক হামলার খবর পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী ও ঢাবি শিক্ষার্থীদের মতে, এসব ঘটনার শুরু হয় একটি কথা দিয়ে। সেটা হচ্ছে, 'ভাই কি ক্যাম্পাসের?'

যদি তিনি না বলেন, তাহলেই শুরু হয় হয়রানি ও নির্যাতন এবং এক পর্যায়ে তাদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের করে দেয়।

অনেক সময় ঢাবির শিক্ষার্থীরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না।

ঢাবির যে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন, তারা ক্যাম্পাসে লাঞ্ছিত বা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন বা তার কোনো বন্ধু এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে শাহবাগ থানার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত কয়েক মাসে ঢাবি ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। হামলা ও ছিনতাইকারীরা খুবই মরিয়া হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, 'এই অপরাধীদের অধিকাংশই ঢাবির শিক্ষার্থী। এমনকি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও ছাড় দিচ্ছে না।'

গত রোববার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এলাকায় কাভার্ডভ্যান চালককে মারধর ও ১৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৩ ঢাবি শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। ঢাকার একটি আদালত গত ৬ ফেব্রুয়ারি তাদের কারাগারে পাঠান।

কাভার্ডভ্যান চালকের চিৎকার শুনে এগিয়ে এসে শাহবাগ থানার একটি টহল দল থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজের শিক্ষার্থী নাবিদ শাকিল, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রাহাত রহমান (২১) এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাদিক আহমেদকে গ্রেপ্তার করে।

তাদেরকে যেদিন কারাগারে পাঠানো হয়, সেদিনই ছাত্রলীগের আরও ২ নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। কেন তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তা তো এখন সহজেই অনুমেয়। তানজির আরাফাত তুষার ও রাহুল রায়ের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠার পর তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়।

কবি জসিমউদ্দীন হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক তুষারকে পুলিশ প্রথমে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। রাহুল ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক নারী ও তার স্বামীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এই ২ জনসহ ৫-৬ জন অজ্ঞাত যুবকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতিকারীরা ভুক্তভোগীদেরকে মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়, মারধর করে, ওই নারীকে হয়রানি করে এবং তার স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

গত ৩০ জানুয়ারি অমর একুশে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান সোহাগের সমর্থকরা বঙ্গবাজারে একটি দোকান ভাঙচুর করেছে। অভিযোগ রয়েছে, দোকানের মালিক চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তারা এই কাজ করেছেন।

ইমদাদুলের সঙ্গে দোকানের মালিকের কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ দ্য ডেইলি স্টারের কাছে রয়েছে। সেখানে শোনা যায় ইমদাদুল দোকানদারকে হুমকি দিচ্ছেন। কথোপকথনের পরের দিন তার দোকান ভাঙচুর করা হয়।

এসব ঘটনা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এই অপরাধীরা খুবই সাবধানে তাদের 'শিকার' নির্বাচন করে। শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা এমন মানুষদেরই লক্ষ্য বানায়, যাদের অভিযোগ বা মামলা করার সম্ভাবনা কম।

ঢাবির শিক্ষার্থী, ভুক্তভোগী ও দোকানদারদের মতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, ভিসি চত্বর, কলা ভবন, ফুলার রোড ও পলাশী এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় রয়েছে।

তারা নিজেদেরকে ঢাবির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দেয়। এই সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে ইদানীং আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চক্রটি।

অন্ধকার রাস্তা, নেই সিসিটিভি

গত মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লিট ফেস্টে অংশ নিয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জারিন তাসনিম।

তিনি বলেন, 'রাত ৮টায় যখন আমি একা বাসায় ফিরছিলাম, তখন উদ্যানের টিএসসি গেট থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তা অন্ধকার। তখন টিএসসিতে রাজনৈতিক সমাবেশ চলছিল।'

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিবেশটা খুবই ভয়ঙ্কর। আমি খুবই দ্রুত হাঁটছিলাম।'

ঢাবি এলাকার রাস্তায় আলোর অভাব একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।

যোগাযোগ করা হলে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, 'ঢাবি এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছি। কেন কাজটি এখনো হয়নি, সেটা জানি না।'

এ ছাড়া, যেসব পয়েন্টে অপরাধ বেশি হচ্ছে সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর দাবি জোরদার হচ্ছে।

ঢাবির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আসিফ হোসেন খান বলেন, 'আমরা ক্যাম্পাসে ৬৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছি। আশা করছি ১ মাসের মধ্যে সেগুলো স্থাপন করতে পারব।'

অবশেষে ব্যবস্থা নিলো ছাত্রলীগ

ঢাবি শিক্ষার্থীরা মনে করেন, যখন ছাত্রলীগ কর্মীরা অপরাধমূলক কাজ করে শিরোনাম হন, তখন নেতারা বলেন, 'সংগঠন ব্যক্তির দায়ভার নেবে না'।

কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয় ছাত্রলীগ, যা সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে এই সংগঠনের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

কিন্তু সম্প্রতি গঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এর ব্যতিক্রম কাজ করছে এবং বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল রোববার সারা দেশে তাদের ২১ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে।

এর মধ্যে ১৫ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তারা হলেন- নাজমুল হাসান, তানজির আরাফাত তুষার, আসাদুল্লাহ আসাদ, মাহিদুর রহমান বাঁধন, রিয়াজ আহমেদ পলক, জিহাদুল ইসলাম, আল কাওসার, শাওন চৌধুরী, ফাহিম তাজওয়ার জয়, সাজিদ আহমেদ, রাহুল রায়, মো. তারেক, ফজলে নাভিদ সাকিল, রাহাত রহমান এবং সাদিক আহমাদ।

একই সঙ্গে অমর একুশে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হাসান সোহাগকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে ছাত্রলীগ ঢাবি শাখা।

গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অসিত পাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মারুফ ইসলাম, শাহ আলম রাতুল ও নুর মোহাম্মদ নাবিল, রুয়েটের কামরান সিদ্দিক রাশেদ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ এনান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো অপরাধী ছাত্রলীগে জায়গা পাবে না। এই বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে নিশ্চিত করছি।'

Comments

The Daily Star  | English
government changed office hours

Govt office hours 9am-3pm from Sunday to Tuesday

The government offices will be open from 9:00am to 3:00pm for the next three days -- from Sunday to Tuesday -- this week, Public Administration Minister Farhad Hossain said today

1h ago