ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের 'দ্বিতীয় সংসদ' হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি ঐতিহাসিক সংগ্রামে ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই স্যার এ. এফ. রহমানের উদ্যোগে তিন আবাসিক হলে (মুসলিম হল, জগন্নাথ হল ও ঢাকা হল) ছাত্র সংসদ গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ।
নামকরণ
শুরুতে একে 'ডাকসু' নামে ডাকা হতো না। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ' থেকে তিন দশক পর নামকরণ হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ'।
এ প্রসঙ্গে ডাকসুর ১৯৯১ সালের এক প্রকাশনায় অধ্যাপক আনিসুজ্জমান লিখেন, 'এখন সবাই বলে ডাকসু। তার অনুকরণে রাকসু, চাকসু, জাকসু, ইউকসু ইত্যাদি চলছে। এই বাংলা প্রচলনের দিনেও কেউ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বলে না, ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলোও ভেঙে বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। অথচ আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, ১৯৫৩ সালে, তখন ডাকসুর নামও শুনিনি। কিছুকাল পরে শুনলাম। কেন, সে কথাটা ভেঙে বলতে হলে সময়ের হিসেবে বেশ পেছনে যেতে হবে।'
হল ছাত্র সংসদের সাফল্যের পর ১৯২২-২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (Dacca University Student's Union) গঠিত হয়। প্রত্যেক হল থেকে তিনজন ছাত্র এবং একজন শিক্ষক আর উপাচার্যের মনোনীত একজন শিক্ষক এই নিয়ে সংসদ। শিক্ষকদের মধ্যে একজন সভাপতি হতেন।
১৯৪৪-৪৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র সংসদের নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করে। এই গঠনতন্ত্রের অধীনে ১৯৪৫-৪৬ সালে উপাচার্য পিজে হার্টগ পদাধিকারবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি হন। ছাত্রদের মধ্যে থেকে সহ-সভাপতি হন আহমেদুল কবির (পরবর্তীতে 'সংবাদ' সম্পাদক) এবং সাধারণ সম্পাদক হন সুধীর দত্ত। পরের বছরেও এই সংসদ থেকে যায়, তবে আহমেদুল কবির পদত্যাগ করায় ফরিদ আহমদ (রাজনীতিবিদ) সহ-সভাপতি হন।
১৯৪৭-৪৮ সালে সহ-সভাপতি হন জগন্নাথ হলের অরবিন্দ বসু এবং সাধারণ সম্পাদক হন গোলাম আযম (রাজনীতিবিদ)। এই সংসদও পরের বছরে থেকে যায় এবং কোনো এক সময়ে গোলাম আযমের বদলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন এ. জেড. খান (পরবর্তীতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক)। তারপর ১৯৫০ সালে তাদের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গঠনের আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জমান লিখেন, '১৯৫৩ সালে আমরা অনার্সের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেন। এবার নাম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ইংরেজি নামই তখন চালু, নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ডাকসু।'
সৈয়দ আবুল মকসুদের এক লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম দুই দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এবং হল সংসদগুলোর কাজ ছিল জ্ঞানচর্চা, আত্ম–উন্নতির উপায় উদ্ভাবন এবং সমাজসেবামূলক। তারা সান্ধ্য বিদ্যালয় পরিচালনা করেছে। খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করেছে। দরিদ্র বস্তিবাসীর মধ্যে সেবামূলক কাজ করেছে। বন্যা, মহামারির মধ্যে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেছে। প্রতি শনিবার হলগুলোতে সন্ধ্যায় আলোচনা সভা হতো। তাতে আলোচনা ও বিতর্ক হতো শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। জাতীয় রাজনীতির বিষয়ও আলোচনা করা হতো, তবে কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করতেন না নেতারা, যদিও কোনো দলের প্রতি তাদের সমর্থন থাকত।
অতীতের নির্বাচন
১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ৩৭ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে সহ-সভাপতি হন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) গোলাম রাব্বানী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।
স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যে একধরনের অনীহা পরিলক্ষিত হয়, যার ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৭ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯১ সালের পর থেকে ডাকসু নির্বাচন একেবারে অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায়।
বারবার থেমে যায় নির্বাচন
১৯৯০ সালের পর ১৯৯১ সালের ১৮ জুন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় সহিংসতার কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচন হয়নি।
১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী উপাচার্য হওয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৯৮ সালে ডাকসু কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। মাঝে মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন এবং সিনেটে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও এসেছে। তবে তাতে কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
২০০৫ সালে ডাকসু নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করলেও, ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচনটি বাস্তবায়িত হয়নি। এই সময় ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করলেও, ছাত্রলীগের প্রতিরোধের কারণে তাদের দাবি বাস্তবায়িত হয়নি।
এরপর ২০১২ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের
দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ' তৈরি করা হয় এবং লাগাতার আন্দোলনও চলে বেশ কিছুদিন। তবে নির্বাচনের দাবি উঠলেও তা খুব জোরালো হয়নি।
২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ের পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের কারণে নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এবারের নির্বাচন
প্রায় ছয় বছর পর আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। এমন এক সময়ে এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যখন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ২৮টি পদের বিপরীতে মোট ৫০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। ৬৫৮টি মনোনয়নপত্র বিক্রি হলেও বুধবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় পর্যন্ত ১৪৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েনি।
এবারের নির্বাচনে অন্তত ৯টি প্যানেলের নাম জানা গেছে। এরমধ্যে রাজনৈতিক প্যানেল ৭টি এবং স্বতন্ত্র ২টি।
তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৫ আগস্ট। পরদিন প্রকাশ করা হবে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা।
Comments