এনসিটিবির ভয়ংকর ব্যবহারিক শিক্ষা কাঠামো

অতি সামান্য কিছু সরজ্ঞাম থাকে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরিতে। ছবি: সৈয়দা আফরিন তারান্নুম

গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন, হাতে টেস্টটিউব। বিকারে অজানা কোনো রাসায়নিক নিয়ে ভীষণ মনোযোগে পরীক্ষায় মত্ত এক কিশোর বা কিশোরী। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য কেবলমাত্র এমন ব্যবহারিক যথেষ্ট না। তার পরিবর্তে এই শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত থাকতে হয় ব্যবহারিক খাতা লেখা নিয়ে।

এমনিতেই দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরি রুমে খুবই কম সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায়। ফলে, শিক্ষার্থীদের পক্ষে ব্যবহারিক পরীক্ষা করার সুযোগ খুবই সীমিত। তার ওপর ব্যবহারিক খাতা লেখায় অত্যধিক গুরুত্বের কারণে শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে নিজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পায় না।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রাথমিক উপলব্ধি তৈরিতে এবং তরুণ এই শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখাতে ব্যবহারিক কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে, পাঠ্যক্রমের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিবর্তে কেন পুঁথিগত জ্ঞানের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে? কেন শিক্ষার্থীদের শুধু মুখস্থ করতে বাধ্য করা হচ্ছে? এতে করে বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানার্জনের যে প্রক্রিয়া, তার পুরোটাই কী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না?

শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যবহারিক কাজ করার পরিবর্তে ব্যবহারিক খাতা লেখায় বেশি মনোযোগী হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর বণ্টন। ব্যবহারিক কাজের জন্য ১৫ নম্বর এবং মৌখিক পরীক্ষা ও ব্যবহারিক খাতার জন্য ৫ নম্বর বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে। দেখতে সব ঠিকঠাক মনে হলেও, এর যথোপযুক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে না, বরং এর ব্যবহার ত্রুটিপূর্ণ।

প্রথমে ব্যবহারিক কাজের নম্বরের বিষয়ে দেখা যাক। দেশের বেশিরভাগ স্কুলে সরঞ্জামের অভাবে জর্জরিত ও অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকা ল্যাবরেটরিগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় অনুশীলনের সুযোগই পায় না। এমনকি শিক্ষক ও ল্যাব সহকারীরাও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত হন না। ফলে পরীক্ষার সময় ব্যবহারিক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত ১৫ নম্বর দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের নির্ভর করতে হয় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ওপর নেওয়া সংক্ষিপ্ত লিখিত পরীক্ষার উপর। আর এই পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয় সাধারণত ওই ব্যবহারিক খাতায় লেখা বিষয়গুলোর মধ্য থেকেই।

এরপর আসে মৌখিক পরীক্ষা। এই অংশটি শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে জটিল। শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তা, দ্রুততম সময়ে কোনো সমস্যার সমাধানসহ এই জাতীয় বিষয় বিবেচনা করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রায়শই শিক্ষকরা এই মৌখিক পরীক্ষার সুযোগটি ব্যক্তিগত কাজে লাগান। তাদের কোচিং ক্লাসে যেসব শিক্ষার্থী যায়, তাদেরকে বেশি নম্বর দেওয়ার একটি সুযোগে পরিণত হয় এই অংশটি। ফলে, ব্যবহারিকে নম্বর বিষয়ে যেসব শিক্ষার্থী চিন্তিত, তারা এই শিক্ষকদের কাছে পড়তে যেতে বাধ্য হয়।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে, ল্যাবরেটরিতে যে পরিমাণ ব্যবহারিক কাজ করার সুযোগ আছে, তারচেয়ে অনেক বেশি ব্যবহারিক কাজ করা হয়েছে মর্মে লিখতে হয় ব্যবহারিক খাতায়। এই বিষয়ে এত বেশি জোর দেওয়া হয়েছে যে, এর সুযোগ নিয়ে শুধুমাত্র ব্যবহারিকের জন্যই আলাদা গাইড বই বিক্রি করে প্রকাশনাগুলো। ব্যবহারিকের সিলেবাসও বছরের পর বছর একই থাকে। ফলে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই গাইড বই বা তাদের সিনিয়রদের ব্যবহারিক খাতা দেখে নিজের খাতা লেখে। অনেকে আবার নিজের খাতা নিজে লেখেও না। ঘোস্ট রাইটারদের সহায়তায় নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খাতা লিখিয়ে নেয়। এমনকি সম্পূর্ণ প্রস্তুত খাতাও কিনতে পাওয়া যায়।

সত্যিকারের ব্যবহারিক শিক্ষা ছাড়া এমন ব্যবহারিক শিক্ষা পাঠ্যক্রম নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ। এর জন্য দায়ী আমাদের সম্মিলিত অবহেলা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাঠ্যক্রম শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বা গণিত বিষয় নেওয়া কোনো শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটখাটো বিষয়েও ব্যবহারিক দক্ষতা দেখাতে না পারেন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কারণ, স্কুল পর্যায়ে তাদের যা শেখার কথা ছিল, তা তারা শেখেনি, শিখতে পারেনি। উচ্চশিক্ষার দৌড়ে এসে তাকে আবার নতুন করে সেগুলো করতে হবে, শিখতে হবে। যার ফল হতে পারে, অনেকের থেকে পিছিয়ে পড়া।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

6h ago