‘এই প্রশ্নের মাধ্যমেই বোঝা যায় কাদের হাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের একটি প্রশ্ন নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এমন প্রশ্নের মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দেওয়া হচ্ছে।
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার বাংলা প্রথম পত্রের একটি প্রশ্ন নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এমন প্রশ্নের মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দেওয়া হচ্ছে।

গত রোববার বাংলা প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেশে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের ১১ নম্বর প্রশ্নে সনাতন ধর্মের ২ ভাইয়ের জমি নিয়ে বিরোধের বিষয় তুলে ধরা হয়।

সেখানে বলা হয়, 'নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির একটি অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।'

ঢাকা বোর্ডের সেই প্রশ্ন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে, শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএ মামুন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েনের সঙ্গে।

তারা সবাই সেই প্রশ্নের সমালোচনা করে এর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেই বিষয়েও সবাইকে বিশেষ সতর্ক থাকার দাবি করেন তারা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'সৃজনশীলতার নামে এই ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি শিক্ষকতার কোনো মাপকাঠিতেই পড়ে না। এই প্রশ্ন পড়ে একজন হিন্দু শিক্ষার্থীর কেমন লাগবে, এটি কি কারো মাথায় আসলো না? পরীক্ষা হলে বসে এমনিতেই একজন শিক্ষার্থী বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে। তারা এই প্রশ্ন পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। একজন শিক্ষক হিসেবে কেউ এই কাজ করতে পারেন না।'

এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'এতে প্রমাণিত হচ্ছে, আমরা শুধু শিক্ষকরা না, পুরো জাতি বিবেকটাকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। কোথায় কার আঘাত লাগতে পারে, কোথায় সামাজিক বিচ্যুতি ঘটতে পারে, কোথায় সহিংসতা ঘটতে পারে শিক্ষকরাই যদি এটি ভুলে যান, তাহলে কাকে আমি আর দোষ দেবো। যারা এই কাজ করেছেন তারা যেন ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন কোনো কিছু না ঘটে তার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলো যেন বিশেষ ব্যবস্থা নেয় সেই দাবি জানাচ্ছি।'

জাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএ মামুন বলেন, 'এই প্রশ্নটি যিনি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই কোনো কলেজের একজন সিনিয়র শিক্ষক হবেন। এমন শিক্ষক যদি না বোঝেন কোন বিষয়ে সমালোচনা হবে, বিতর্কের সৃষ্টি হবে তাহলে আর কিছুই বলার নেই। সৃজনশীলতার নামে যা করা হয়েছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই প্রশ্নটি ভিন্নভাবেও করা যেত। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ভুল না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এ ধরনের ভুল গ্রহণযোগ্য নয়।'

অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, 'এই প্রশ্নের মাধ্যমেই বোঝা যায় কাদের হাতে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। কাদের হাতে আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ। এই প্রশ্নে যা করা হয়েছে সেটা পুরোটাই সাম্প্রদায়িকতা। এই প্রশ্নের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতাকে সাধারণীকরণ ও সহজীকরণ করা হয়েছে।'

কাবেরী গায়েনের মতে, 'এই প্রশ্নের মাধ্যমে ২ ভাইয়ের সম্পর্ক, হিন্দু-মুসলিমের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক, সব জায়গাতেই সংকট তৈরি করা হয়েছে। এটি কিন্তু একদিনে হয়নি। কারো মনে সাম্প্রদায়িকতা না থাকলে প্রশ্নপত্রে কখনই এভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি আসার কথা না। এই মনস্তাত্ত্বিক জায়গাটি পরিবর্তন না করতে পারলে সামনে আমাদের আরও বড় বিপদ হবে। মানুষের মধ্যে পরস্পর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের জায়গাটি আর থাকবে না। এই মনস্তাত্ত্বিক জায়গার পরিবর্তন করতে হবে।'

'জড়িতদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়', তিনি যোগ করেন।

এই বিষয়ে জানতে প্রশ্নপত্রটির প্রণেতা ঝিনাইদহের ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পালের মুঠোফোন একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

 

Comments