বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

ট্রাস্টি বোর্ডে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখার নিয়ম এনে আইনে পরিবর্তন

প্রয়োজনে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার ও ইউজিসি
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের অন্তত এক তৃতীয়াংশ সদস্যকে শিক্ষাবিদ হতে হবে—এমনটিই বলা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর খসড়া সংশোধনীতে।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে ৯ থেকে ২১ জন সদস্য থাকতে পারেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুকূল অ্যাকাডেমিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ট্রাস্টি সদস্যদের এক তৃতীয়াংশ শিক্ষাবিদ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ট্রাস্টি সদস্যরা কোনো সভার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার জন্য কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না। তা ছাড়া ট্রাস্টি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো লাভজনক পদেও থাকতে পারবেন না।

খসড়ায় আনা অন্যান্য বড় পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে—অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যবেক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার বা ইউজিসিকে ক্ষমতা দেওয়া।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি এই খসড়াটি তৈরি করেছে এবং ইতোমধ্যে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই কমিটি গঠন করা হয়।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বৃহস্পতিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আরও স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে নতুন সংশোধনী আনা হয়েছে।'

বিদ্যমান আইন সংশোধনের কারণ ব্যাখ্যা করে খসড়ায় বলা হয়, 'সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অ্যাকাডেমিক, আর্থিক ও প্রশাসনিক জায়গায় অনিয়মের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া উদ্বেগের বিষয়।'

এতে বলা হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি ইউজিসির ক্ষমতায়ন ও কঠোর আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রামগুলোতে কত শিক্ষার্থী থাকবে, তা নির্ধারণ করবে ইউজিসি। একইসঙ্গে ওই প্রোগ্রামে কত শিক্ষার্থী ভর্তি হলো এবং পাস করল, সেই তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু ইউসুফ মিয়া জানান, খসড়া চূড়ান্ত করতে মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে দেশে ১১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ১৯৯২ সালে একটি আইনের মাধ্যমে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ২০১০ সালে ওই আইনের সংশোধন করা হয়।

শিক্ষাবিদ ও পর্যবেক্ষক

খসড়ায় বলা হয়েছে, ইউজিসির সুপারিশ ও সরকারি অনুমোদন ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডে কোনো পরিবর্তন হবে না। প্রয়োজনে ইউজিসি বা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিতে পারে।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ট্রাস্টি বোর্ডের শিক্ষাবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।

তিনি আরও বলেন, পর্যবেক্ষক নিয়োগ তখনই হবে, যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংকটের মুখোমুখি হবে অথবা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কিংবা এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম হবে। অনেক সময় কর্তৃপক্ষ ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউজিসি কর্মকর্তা বলেন, 'ট্রাস্টি সদস্যদের এক তৃতীয়াংশ যদি শিক্ষাবিদ হয়, তাহলে বোর্ডে ভারসাম্য থাকবে।'

ইউজিসি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অনেক সময় ট্রাস্টিদের 'মুনাফা অর্জনের মনোভাবের' কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে 'প্রতিকূল' অ্যাকাডেমিক পরিবেশ তৈরি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ এবং তাদের কেউ কেউ শিক্ষাবিদ।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমি মনে করি ট্রাস্টি বোর্ডে আরও বেশি শিক্ষাবিদ রাখার সিদ্ধান্তটি ভালো। ট্রাস্টিরা যে লাভজনক পদে থাকতে পারবে না, সেই বিষয়টিও ইতিবাচক। ট্রাস্টি বোর্ডের অনেক সদস্যই দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেন না, তারা কেবল কিছু সুবিধা নিতে চায়।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশের (এপিইউবি) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, 'শিক্ষাবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করলে এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। তারা নিজেরাই বিনিয়োগ করতে পারে অথবা সরকার তাদের পক্ষে বিনিয়োগ করতে পারে।'

পর্যবেক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সাধারণত কোনো কোম্পানি লোকসানের মুখে পড়লে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগের কোনো কারণ নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই চ্যান্সেলর ও ইউজিসির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা পর্যবেক্ষকের মতো কাজ করে।'

'সাধারণত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা সিটিং ভাতা নেন না। ট্রাস্টি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভজনক পদে থাকা উচিতও নয়, কারণ তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট', বলেন তিনি।

আরও জায়গা ও সংরক্ষিত তহবিল

খসড়া সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন বা ভাড়ায় কমপক্ষে এক লাখ বর্গফুট জায়গা থাকলে তারা অনুমোদন পাবে। বর্তমানে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা থাকলেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পায়।

এতে বলা হয়েছে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৫ একর জমি থাকতে হবে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রণয়নের আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে এক একর এবং অন্যান্য এলাকায় ২ একর জমি থাকার বিধান রয়েছে।

সংরক্ষিত তহবিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ কোটি টাকা, অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য এলাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ কোটি টাকা থাকতে হবে। বিদ্যমান আইনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সংরক্ষিত তহবিল ৫ কোটি টাকা, অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরের জন্য ৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য থাকতে হয় দেড় কোটি টাকা।

নতুন খসড়ায় সরকারি সর্বশেষ আদেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নারী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নির্ধারণ এবং শিক্ষকদের অধ্যয়ন ছুটির জন্য একটি গাইডলাইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

টিউশন ফি

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসির অনুমোদন নিয়ে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে টিউশনসহ অন্যান্য ফি নির্ধারণ করতে পারে।

খসড়া সংশোধনীতে এই বিধানটি বহাল রাখা হয়েছে। তবে এতে যোগ করা হয়েছে যে, বিদ্যমান ফি কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আনার আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমোদন নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যখন কোনো কোর্সে ভর্তি হবে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিতে পরিবর্তন আনা যাবে না।

Comments