‘শিশুদের মনে চাপ সৃষ্টি হয়’, পাঠ্যবই থেকে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বাদ দিতে আইনি নোটিশ

২০২৬ সালের পাঠ্যবই থেকে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব (থিওরি অব ইভুলেশন) বাদ দিতে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যানের উদ্দেশে জনস্বার্থে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন রাজধানীর খিলক্ষেতের বাসিন্দা মো. আরিফ।
রোববার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন তার পক্ষে এই আইনি নোটিশ পাঠান।
পরে এ বিষয়ে এক ব্রিফিংয়ে আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন বলেন, 'নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষা কারিকুলামে ডারউইনের থিওরি মানবজন্মের বিবর্তনবাদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি অধ্যাপক জাফর (জাফর ইকবাল) গত রেজিমে ইনক্লুড করেছিলেন। যা নিয়ে অত্যন্ত সমালোচনা হয়েছে, বিতর্ক হয়েছে ও সংসদে আলোচনা হয়েছে।'
'পৃথিবীর কোথাও ক্যামব্রিজের কারিকুলামে ও-লেভেলে এবং অনেক দেশে মাধ্যমিক লেভেলে এই বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় না' বলেও এসময় দাবি করেন তিনি।
যদিও ২০১৮ সালে মার্কিন বিজ্ঞান শিক্ষাবিদ হাসান ডেনিজ ও লিসা বোর্গার্ডিংয়ের লেখা 'ইভুলেশন এডুকেশন অ্যারাউন্ড দ্য গ্লোব' বইতে উঠে এসেছে যে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রদেশে প্রাথমিক পর্যায়েই (১০ বছরের আগে) ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পড়ানো হয়।
এমনকি অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, গ্রিস, ইরান, কুয়েত, লুক্সেমবার্গ, মেক্সিকো, স্কটল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রদেশে ১০-১৩ বছরের শিশুদের পাঠ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ ছাড়া, ব্রাজিল, মিশর, গ্রিস, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, তিউনিশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রদেশে স্কুল লেভেলে (১৪ বছরের পর) বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পড়ানো হয়।
আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন ব্রিফিংয়ে বলেন, 'বিবর্তনবাদ পড়ানো হলে কোমলমতি শিশুদের মনে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়, সেজন্য ক্যামব্রিজের শিক্ষা কারিকুলামে মাধ্যমিক লেভেলে তারা এটি ইনক্লুড করেনি। সেজন্য আমরা জনস্বার্থে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব ও এনসিটিবি চেয়ারম্যানের বরাবর একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি, যাতে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক লেভেলে এই বিবর্তনবাদ অন্তর্ভুক্ত করা না হয়।'
বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো সাধারণত দুটি ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুসরণ করে। যেমন: কেমব্রিজ ও এডেক্সেল কারিকুলাম। এ ছাড়াও, কিছু স্কুল আন্তর্জাতিক ব্যাক্কালরিয়েট (আইবি) ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম অফার করে, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রোগ্রাম।
বাংলাদেশে কেমব্রিজ ও এডেক্সেল, দুই কারিকুলামেই ও-লেভেলে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পড়ানো হয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
রাজধানীর সাউথ ব্রিজ স্কুলের শিক্ষক রাফিয়া আমান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হ্যাঁ, এটি (বিবর্তনবাদ তত্ত্ব) কেমব্রিজ ও এডেক্সেল কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা সাধারণ জীববিজ্ঞানের পাঠ্যবই, যেমন: বি এস বেকেটের মতো লেখকদের লেখা এবং কারিকুলামে সুপারিশকৃত পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করি। আমি প্রায় এক দশক ধরে শিক্ষার্থীদের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পড়াচ্ছি।'
ব্রিফিংয়ে আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন বলেন, 'মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে, আদম এবং হাওয়া থেকে মানবজাতির জন্ম হয়েছে, যা ইসলাম ধর্মে প্রিচ করা হয়। আর এই বিবর্তনবাদে বলা হয়েছে, মানুষের সৃষ্টি হয়েছে বানর থেকে। এটি গবেষণার জন্য ইউনিভার্সিটি লেভেল উচ্চপর্যায়ে পড়াতে পারে, কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে যেহেতু পৃথিবীর কোনো দেশে নেই, আমাদের দেশে এটি থাকা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। যেখানে ৯২ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী, সেজন্যই আমরা জনস্বার্থে এই লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেছি।'
'এতে রিপারকেশন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ ক্যামব্রিজের কারিকুলামে নেই, ও-লেভেলের কারিকুলামে নেই, ইন্ডিয়াসহ অনেক দেশে মাধ্যমিক লেভেলে নেই, উচ্চপর্যায়ের লেভেলে আছে। আমাদের এখানে দাবি হলো, মাধ্যমিক পর্যায়ে এই পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত নয়', বলেন তিনি।
যদিও সাউথ ব্রিজ স্কুলের আরেক শিক্ষক আলফ্রেড ডি সিলভাও ক্যামব্রিজ কারিকুলামে ও-লেভেলে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব পড়ানোর বিষয়টি ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব ও এনসিটিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, তবে কেউ সাড়া না দেওয়ায় তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
'অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস' নামে ডারউইনের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। তার এই গ্রন্থে তিনি বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণী ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে একসময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়।
কিন্তু চার্লস ডারউইনের আগে ইসলামিক বিশ্বেও বিবর্তনবাদ তত্ত্বের আরও একজন প্রবক্তা ছিলেন।
বিবিসি ২০১৯ সালে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, চার্লস ডারউইনের প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরাকে একজন মুসলিম দার্শনিক ছিলেন, যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার ওপর একটি বই লিখেছিলেন। এই দার্শনিকের নাম আল-জাহিজ। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন 'প্রাকৃতিক নির্বাচন'।
Comments