বিদেশি জাতের মুরগি পালনে ভাগ্য বদলেছে রাজবাড়ীর জাহাঙ্গীরের

মো. জাহাঙ্গীর হোসেন | ছবি: স্টার

ভাগ্য পরিবর্তনে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউরোপের কোনো একটি দেশে যেতে চেয়েছিলেন রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার বড় বাংলট গ্রামের মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। প্রতারণার শিকার হয়ে যান ভারতে। প্রায় ৫ মাস চেন্নাই শহরে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন তিনি।

দেশে ফেরার সময় ৩ জোড়া বিদেশি জাতের মুরগি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন জাহাঙ্গীর। ৬ বছরে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আরও ৪০ প্রজাতির মুরগি সংগ্রহ করেছেন। এখন তার খামারে ২০০টি মুরগি রয়েছে।

ছবি: স্টার

জাহাঙ্গীরের বাবা আমিন হোসেনের ১৫ বছর আগে মৃত্যু হয়। আর্থিক অনটনে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে নামতে হয় কাজের সন্ধানে। ২০১১ সালে জাহাঙ্গীর শ্রমিক হিসেবে মালদ্বীপে যান। সেখানে তেমন সুবিধা করতে না পেরে ২০১৫ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

জাহাঙ্গীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মালদ্বীপ গিয়ে যখন ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারলাম না, তখন ভাবলাম ইউরোপে গিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করবো। তাই স্থানীয় দালালদের সঙ্গে ৬ লাখ টাকায় চুক্তি করি। তারা আমাকে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ভারতে পাঠাবে, তারপর ইউরোপে। সে রকম হয়নি, দালাল চক্র আমাকে চেন্নাইয়ে ছেড়ে দেয়। সেখানে কাজ করার সময় আমি বিভিন্ন জাতের মুরগি দেখি। দেখে আমার ভালো লাগে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই দেশে ফিরে আমি বিদেশি মুরগির খামার গড়ে তুলবো।'

ছবি: স্টার

ছোটবেলা থেকে আমার পশু-পাখির প্রতি ভালো লাগা কাজ করতো। ২০০৭ সালে আমি মুরগি পালনের ওপর যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, বলেন জাহাঙ্গীর।

ভারত থেকে ফেরার সময় জাহাঙ্গীর ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করে ব্রাহমা, সিল্কি ও মিলি জাতের মোট ৬টি মুরগি নিয়ে এসেছিলেন। মুরগিগুলো প্রথমে তার শোবার ঘরের কোণে রেখে পালন করতে শুরু করেন।

ছবি: স্টার

তিনি বলেন, 'বাণিজ্যিকভাবে খামার করতে পারবো সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। প্রথমে শখের বশে মুরগি পালন শুরু করেছিলাম। দিনে দিনে মুরগির সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। তথ্য একটাকে ব্যবসা হিসেবে নিলাম। মুরগি, বাচ্চা, ডিম বিক্রি করে এখন প্রতি মাসে আমার আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।'

এখন জাহাঙ্গীরের সংগ্রহে রয়েছে সিল্কি, সেব্রাইট গোল্ডেন, সিলভার সেব্রাইট, বাফ সেব্রাইট, পলিস ক্যাপ, ক্রেস্টেড পলিস ক্যাপ, উইন্ডোট, মিলি, বেলজিয়াম বিয়ার্ড, ব্রাহামা, কলম্বিয়ান ব্রাহমা, ল্যাভেন্ডার ব্রাহমা, এরা কনা, বার্বি ডিনার, অনাকাদুরি, কসমো, সেরমা, ফনিক্স, ইয়োকোহামা, সুমাত্রা, সুলতান, আইয়ামচিমনি, লেকেল ভেন্ডার, ব্লু-কোচিন, মলটেট কোশ্চেন, ব্লু-ফিজেল, পেন্সিল লেগ, গেম বেন্থাম, জায়ান্ট কোচিন, ব্লু-বারলেচ, সিলভার লেস, জাপানিজ বেন্থাম, চাবু, প্যারট লিপ, আঁচিল, স্প্যানিশ হোয়াইট ফেস, ডংতাও, জঙ্গল ফাউ, আমেরিকান ব্রাহমা, রেড বারবন জাতের মুরগি।

ছবি: স্টার

প্রতি জোড়া মুরগি জাহাঙ্গীর ৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকায় পর্যন্ত বিক্রিয় করেন। এসব জাতের মুরগি সংগ্রহ করতে তিনি নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন।

জাহাঙ্গীর আরও বলেন, 'এই আবস্থায় আসতে আমার ৫ বছর সময় লেগেছে। খামার গড়ে তুলতে সব মিলিয়ে ১৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১২ লাখ টাকা।'

ছবি: স্টার

'সব বয়সের মানুষ আমার কাছ থেকে মুরগি সংগ্রহ করেন, তবে ‍যুবকদের আগ্রহ বেশি। মোবাইল ফোনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইত্যাদি এগ্রো অ্যান্ড হ্যাচারি ডটকম নামে আমার নিজের একটি ওয়েব পেইজ আছে। সেখান থেকে ক্রেতারা আমার খোঁজ পায়,' বলেন তিনি।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. নাজমুল ইসলাম জানান, তিনি জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মুরগি সংগ্রহ করে ১ বছর ধরে বিক্রি করে আসছেন। তিনি ৩ দিন বয়সী বাচ্চা কিনে ২ থেকে ৩ মাস পালন করেন। তারপর জাত ভেদে ২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করেন। বাংলাদেশে এ ধরনের খামার খুব বেশি নেই, তাই বেশি লাভ করা যায়।

ছবি: স্টার

রাজবাড়ীর পাংশা সারকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মারজান শরীফ জানান, তিনি ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখে জাহাঙ্গীরের মুরগির খামারের খোঁজ পান। এরপর ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মোট ৭ জোড়া মুরগির বাচ্চা কেনেন।

শরীফ বলেন, আমার ইচ্ছা জাহাঙ্গীরের মতো আমিও একদিন বড় খামারি হবো।

ছবি: স্টার

'আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন যারা বিদেশ থেকে অনেক টাকা ব্যয় করে এসব জাতের মুরগি সংগ্রহ করেন। আমি চাই যাতে, আমাদের দেশেও এসব মুরগি হয়,' বলেন জাহাঙ্গীর। 

কয়েক মাস আগে দেড় লাখ টাকায় একটি মুরগি বিক্রি করেছেন, জানান তিনি।

ছবি: স্টার

জাহাঙ্গীরের মা জাহিদা বেগম জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কষ্ট দূর করার জন্য তার ছেলে বিদেশে গিয়েছিল কিন্তু কষ্ট কমেনি। এই মুরগি পালন শুরুর পরে তাদের আর্থিক কষ্ট দূর হয়েছে।

ছবি: স্টার

রাজবাড়ী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলুল হক সরদার বলেন, জাহাঙ্গীরের খামারটি একটি ব্যতিক্রম খামার। আমরা সব সময় তাকে সব ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দিচ্ছি। এ ধরনের খামার আরও তৈরি হলে আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

A captain cannot abandon ship, especially when the sea is turbulent

9h ago