র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়ে দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল: করভি রাখসান্দ

এশিয়ার নোবেলখ্যাত এবং তুলনামূলকভাবে প্রায় বিতর্কহীন র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছেন জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাখসান্দ। এই পুরষ্কার প্রবর্তনের ৬৫তম বার্ষিকীতে করভিকে 'উদীয়মান নেতা' হিসেবে এই স্বীকৃতি দিয়েছে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই কর্তৃপক্ষ।
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাকসান্দ
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাকসান্দ। ছবি: সংগৃহীত

এশিয়ার নোবেলখ্যাত এবং তুলনামূলকভাবে প্রায় বিতর্কহীন র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার-২০২৩ পেয়েছেন জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভি রাখসান্দ। এই পুরষ্কার প্রবর্তনের ৬৫তম বার্ষিকীতে করভিকে 'উদীয়মান নেতা' হিসেবে এই স্বীকৃতি দিয়েছে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই কর্তৃপক্ষ।

পুরস্কার পাওয়ার পর টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রতিক্রিয়াসহ জাগো ফাউন্ডেশন সম্পর্কে জানিয়েছেন করভি রাখসান্দ

দ্য ডেইলি স্টার: কিছুক্ষণ আগে এশিয়ার নোবেলখ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ৪ জন পেয়েছেন এবারের পুরস্কার। তার মধ্যে করভি রাখসান্দ মানে আপনি একজন। এই পুরস্কার পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। পুরস্কার পাওয়ার সংবাদ জেনে কেমন লাগছে?

করভি রাখসান্দ: ধন্যবাদ আপনাদেরকেও। এত বড় এত সম্মানজনক পুরস্কার পাব, তা ভেবে তো কাজ করিনি। আমরা সবসময় আমাদের কাজ করে গিয়েছি। র‌্যামন ম্যাগসাইসাই কর্তৃপক্ষ যেটা জানাল যে, ৫ বছর ধরে তারা আমার ও জাগো ফাউন্ডেশনের কাজ মনিটর করছে। ব্যাপারটায় আমরা খুবই অবাক হয়েছি। আমরা কিছুই জানতাম না। তারা দীর্ঘ এই সময় রিসার্চসহ বিভিন্নভাবে আমাদের তথ্য সংগ্রহ করেছে।

এই অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অবশ্যই অত্যন্ত আনন্দের। কারণ অতীতে দালাই লামা বা মাদার তেরেসার মতো মানুষ, আমাদের দেশ থেকে স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মানুষ এই অ্যাওয়ার্ডটা পেয়েছেন। সেই তালিকায় আমাদের মতো মানুষের নাম আসা, আমি বলব যে এতে দায়িত্বও আরও বেড়ে গেল। একইসঙ্গে এই ধরনের অ্যাওয়ার্ড পেলে আরও দ্বার উন্মুক্ত হয়। আগে হয়ত আমাদের মডেলটা নিয়ে আমরা দেশের ভেতর কাজ করতে চেয়েছি। এখন একই মডেল নিয়ে আমরা দেশের বাইরেও যেতে পারি। সেক্ষেত্রে এটা বাংলাদেশের জন্যই গর্বের হবে।

ডেইলি স্টার: জাগো ফাউন্ডেশন ভলান্টিয়ারমূলক কাজ করে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে জাগো ফাউন্ডেশনের বিস্তারিত কাজ সম্পর্কে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। এই সুযোগে আপনি কি একটু বলবেন আপনাদের কার্যক্রম সম্পর্কে?

করভি রাখসান্দ: জাগো ফাউন্ডেশনের যাত্রা ২০০৭ সালে শুরু হয় একেবারেই ভলান্টিয়ারির ইচ্ছে থেকে যে, আমরা সুবিধাবঞ্চিত কিছু শিশুকে ইংরেজি শেখাব। শুরুটা ছিল একেবারেই এরকম যে, আমাদের হাতে যেহেতু সময় আছে, আমরা নিজেরাও শিক্ষার্থী ছিলাম, তাই আমরা শিশুদের সাহায্য করব। শিশুদের সাহায্য করা সহজ। কারণ বড়রা তো আমাদের কথা শুনবে না। সেভাবেই ১৭ শিশুকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সেখান থেকে যখন শিশুরা বলল, স্যার আমাদের প্রমোশন কবে হবে, আমরা বুঝলাম যে, তাদের কল্পনায় এটা একটা স্কুল। তখন আমরা একটা স্কুল করলাম রায়েরবাজার বস্তিতে। এটা করার পর মনে করলাম, কড়াইল বস্তিতে আরেকটা স্কুল করা দরকার। দুয়েক বছর যাওয়ার পর বুঝলাম যে ঢাকায় তো অনেকেই কাজ করছে, এর বাইরেও আসলে কাজ করা প্রয়োজন।

সেই জায়গা থেকেই যখন ঢাকার বাইরে গেলাম, তখন আমরা একটা বড় সমস্যার মুখোমুখি হলাম। দেখলাম, আমাদের উদ্দেশ্য যত ভালোই থাকুক না কেন, ঢাকার শিশুদের মধ্যে আমরা যে ইতিবাচক ফলাফলটা আনতে পেরেছি, বাইরে সেটা পারছি না। এর মূল কারণ সেখানে ভালো শিক্ষক ছিল না। তখনই আমরা অনলাইন স্কুলের কনসেপ্টটা নিয়ে আসলাম। যেটা হলো ঢাকায় বসে আমরা ভিডিওর মাধ্যমে শিশুদের পড়াব। কোভিডের সময় মানুষ দেখল যে এটাও সম্ভব। কিন্তু ২০১১ সালে যখন আমরা এটা শুরু করেছিলাম, মানুষ হাসাহাসি করেছিল যে- এভাবেও পড়াশোনা সম্ভব!

এরপর যেটা ঘটল, এই কাজগুলো করার সময় অনেক তরুণই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল যে, তারা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে চায়। তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, ব্যক্তিগতভাবে আমার বা জাগো ফাউন্ডেশনের ইচ্ছে শিশু ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা হলেও ওই তরুণদের যে উৎসাহ, তাদের ইচ্ছে হলো আমরা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ও উইমেন এমপাওয়ারমেন্টসহ আরও নানা ধরনের বিষয় নিয়েও কাজ করব। নানা ধরনের আইডিয়া আসতে থাকল। কিন্তু আমরা চিন্তা করলাম যে, এত আইডিয়া নিয়ে তো আমরা কাজ করতে পারব না। তখন আমরা একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করলাম, যেটার নাম হচ্ছে— ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ।

এই প্ল্যাটফর্মের আইডিয়াটা ছিল যে, প্রাণবন্ত মানুষদের একসঙ্গে করব, তারা নিজেরা একটা গ্রুপ করে কাজ করবে। ২০১১ সালে ২ মে যখন আমরা এই আইডিয়াটা শেয়ার করলাম, তখন আমরা দেখলাম চট্টগ্রাম থেকে, রাজশাহী থেকে, সিলেট থেকে তরুণরা বলছে, 'ভাই আমাদের এখানে তো কিছু নেই, আমরাও কাজ করতে চাই'। সেখান থেকে শুরু করে এখন বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ৫০ হাজার তরুণ বিভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই ৫০ হাজার মানুষকে কীভাবে মেনটেইন করি। আসলে আমরা তো মেনটেইন করি না। প্রত্যেকটা জেলায় যে তরুণরা আছে, তারা নিজেরাই নির্বাচন করে নেতৃত্ব ঠিক করে। নির্বাচিতরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোন লক্ষ্যটা তাদের জেলায় দরকার। এভাবে আমাদের যাত্রাটা অনেক বছর ধরে চলেছে।

ডেইলি স্টার: জাগো ফাউন্ডেশন এখন তো আর ভলান্টিয়ার অর্গানাইজেশন না।

করভি রাখসান্দ: না, ঠিকই বলেছেন। ২০২০ সালে এসে আমরা এনজিওর লাইসেন্স পাই। তারপর এখন আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর আগে পুরোটাই ছিল দেশের মানুষ, দেশের টাকা, দেশের মধ্যে দেশের স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে।

ডেইলি স্টার: এনজিওর লাইসেন্স পাওয়ার পর আপনারা বাইরে থেকেও সহায়তা পাচ্ছেন?

করভি রাখসান্দ: এনজিওর লাইসেন্স পাওয়ায় এখন ইউনিসেফ, ইউএসএইড, এসসিপিওর যে বড় বড় ডোনার আছে, তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। আগে যেহেতু আমাদের ওই লাইসেন্সটা ছিল না, তাই আমরা এত বড় ফান্ড নিয়ে কাজ করতে পারতাম না। এখন সেটা আমরা পারছি।

এখন যেমন আমরা ইউনিসেফের সহায়তায় বান্দরবানে সাড়ে ১৩ হাজার শিশুকে পড়াচ্ছি। যে শিশুরা কোভিডের সময় ঝরে পড়েছিল, তাদের আমরা স্কুলে ফেরত আনছি। ইউএসএইডের ফান্ডে একটা প্রোগ্রাম করছি, যেখানে আমরা ৫৫ হাজার তরুণকে, যারা ঝরে পড়েছে বা এডুকেশন শেষ করতে পারেনি, যাদের এই মুহূর্তে চাকরি নেই, তাদেরকে কীভাবে স্কিল শেখানোর মাধ্যমে চাকরিতে আনব, সেটার কাজ চলছে।

আমরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়েও কাজ করছি। আমাদের যাত্রাটা ১৬ বছরের। ফলে যারা প্লে গ্রুপে শুরু করেছিল, তাদের অনেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর মেয়েদের সংখ্যা কমে যায়। কারণ তাদের সাপোর্ট কম। গত বছর জাগো ওমেন স্কলারশিপ চালু করেছে। এর মাধ্যমে মেধাবী যে মেয়েরা আছে, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু আর্থিক কারণে শিক্ষা-কার্যক্রম চালাতে পারছে না, তাদেরকে আমরা স্কলারশিপ দেওয়া শুরু করেছি। গত বছর ১০০ মেয়েকে আমরা এই স্কলারশিপ দিয়েছি। এই বছর ১৬০ জনকে দেওয়া হয়েছে। যারা এটা পাবে, তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছরই এটা পাবে। প্রতি বছরই নতুন নতুন মেয়েদের আমরা এই স্কলারশিপ দেবো।

ডেইলি স্টার: এখন তো দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সন্তানেরা জাগো ফাউন্ডেশনের স্কুলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু প্রথম দিকে ঢাকার রাস্তায় আমরা যেটা দেখতাম, তরুণরা হলুদ রংয়ের টি-শার্ট পরে কিছু একটা বিক্রি করছে অথবা টাকা তুলছে। তাদের দেখে মনে হতো যে, তারা সমাজের একটু অগ্রসর শ্রেণি বা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছে। 

করভি রাখসান্দ: ঠিক। শুরুর দিকে কিন্তু বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়েই আমরা শুরু করেছিলাম। আমি স্কলাসটিকায় পড়াশোনা করেছি। আমার বন্ধু-বান্ধবরাও সেখান থেকে এসেছে। আপনি যে ঘটনাটি বলছেন, সেটা হলো বিশ্ব শিশু দিবস পালন করার জন্য। আমরা যেটা করেছিলাম, রাস্তায় যে শিশুরা ভিক্ষা করে বা কিছু বিক্রি করে, তাদেরকে আমরা ওই দিনটাতে ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কে নিয়ে যেতাম। আর তাদের জায়গায় এই রোলটা আমরা প্লে করতে দিতাম যারা একটু প্রিভিলাইজ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে, তাদের। দেখার জন্য যে, পথে যে শিশুরা থাকে তাদের জীবনটা কেমন, সেই অভিজ্ঞতার জন্য। সেখান থেকে শুরু। আমরা যখন মানুষকে ফুল দিয়েছি, তারা টাকা দিয়েছে যে, তোমরা তো ভালো কাজ করছ। আমরা কিন্তু সেভাবে টাকা তোলার কথা চিন্তা করে কাজটা করিনি। তারপর যখন দেখলাম যে মানুষ টাকা দিচ্ছে, তখনই কিন্তু আমরা আমাদের দ্বিতীয় স্কুলটা করলাম। এভাবে করেই অর্গানিকভাবে পুরো জিনিসটা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যারা জাগো ফাউন্ডেশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়, বাইরে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে কি তারা বিশেষ কোনো সুবিধা পায়?

করভি রাখসান্দ: অবশ্যই। গত ৫-৭ বছর ধরে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসগুলোকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। যেটা তারা দেখে যে, রেজাল্ট ভালো, কিন্তু এর সঙ্গে আর কী করেছ? তোমাকে স্কলারশিপ দেওয়া হবে, পড়াশোনা শেষে ফিরে গিয়ে তুমি দেশের জন্য কী করবে। সুনির্দিষ্টভাবে ৪টি দেশ— যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া— এই ৪ দেশে যেহেতু আমাদের প্রচুর কাজ হয়, সেহেতু তাদের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। যারা এসব দেশে যেতে চায়, তাদের অনেকেই আমাদের এখানে এসে ইন্টার্নশিপ বা ভলান্টিয়ারি করছে। বিশেষ করে এসএসসির পর যে গ্যাপটা তারা পায়, তখন এসে অনেকে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু স্কলারশিপ বা বাইরে পড়ার জন্য না, যারা স্কুল লাইফে থাকতে ইন্টার্নশিপটা করবে, তারা রিয়েলিটি জানতে পারে। এর মাধ্যমে তারা কোন বিষয়ে পড়বে, তা ঠিক করাসহ ক্যারিয়ার নির্ধারণ সহজ হয়।

সবশেষে বলতে চাই, ভলান্টিয়ারমূলক কাজের জন্য প্রতিষ্ঠিত জাগো ফাউন্ডেশন বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে এনজিও হিসেবে কাজ করছে। ঢাকায় আমাদের প্রধান কার্যালয় বনানীতে। আর ঢাকার বাইরেও ১৪ জায়গায় আমাদের অফিস আছে। আমাদের এনজিওতে বর্তমানে ৬০০ জন কাজ করছে। আমরা সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করা, সবার মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া ও তরুণ-তরুণীদের সমাজ পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যাব। শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমরা নিজেদের পরিধি বিস্তার করব।

 

Comments