আসপিয়া ও স্থায়ী ঠিকানার ঝক্কি

'দুই দিনের দুনিয়া'য় 'সংসার অনিত্য' হলেও জাগতিক কোনো কোনো ব্যাপারে প্রয়োজন 'স্থায়ী ঠিকানা'। শুধু প্রয়োজন না, মারাত্মকভাবেই প্রয়োজন। বরিশালের আসপিয়ার চাকরি হওয়া না হওয়ার দোলাচল এই স্থায়ী ঠিকানার প্রয়োজনের বিষয়টাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
বুধবার পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আক্তাতারুজ্জামানের কার্যালয়ে হাজির হন আসপিয়া। ছবি: সংগৃহীত

'দুই দিনের দুনিয়া'য় 'সংসার অনিত্য' হলেও জাগতিক কোনো কোনো ব্যাপারে প্রয়োজন 'স্থায়ী ঠিকানা'। শুধু প্রয়োজন না, মারাত্মকভাবেই প্রয়োজন। বরিশালের আসপিয়ার চাকরি হওয়া না হওয়ার দোলাচল এই স্থায়ী ঠিকানার প্রয়োজনের বিষয়টাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।

আসপিয়া পুলিশ কনস্টেবল পদের জন্য বরিশাল জেলায় আবেদন করেছেন। বিভিন্ন ধাপের পরীক্ষা সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করে তিনি নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে গিয়ে আটকে যায় ব্যাপারটা।

খবর ছড়িয়ে পড়ল, ভূমিহীন বলে আসপিয়ার চাকরি হচ্ছে না পুলিশে। এই খবর ফেসবুকে ভাইরাল হলো। পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হলো। কবি নির্মলেন্দু গুণ তো এর প্রতিবাদে অনশনের হুমকি দিলেন। তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেন অনেকে। গাজীপুরে একজন আসপিয়ার নামে জমি লিখে দিতে চাইলেন বলেও খবর বেরোলো পত্রিকায়। ভূমিহীনকে ভূমিদান নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ। কিন্তু, গাজীপুরে জমির মালিকানা তাকে এই চাকরির জন্য উপযুক্ত করবে কিনা সেটা দ্বিতীয়বার ভাববার বিষয়। ভাববার বিষয়, ভূমিহীন হওয়ার ব্যাপারটাই কি এখানে মূল ইস্যু?

এখানে মূল ইস্যু হচ্ছে, তিনি বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা কি না। কারণ, এই পদগুলোতে জেলাওয়ারী নিয়োগ হয় জেলাওয়ারী নির্ধারিত পদ সংখ্যার বিপরীতে। যিনি যে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা তিনি সেখানে পরীক্ষা দিয়ে সেই জেলার পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন ওই জেলার জন্য যতগুলো পদ নির্ধারিত আছে তার একটি পাওয়ার জন্য।

অনেক দিন ধরে অভিযোগ রয়েছে, অন্য জেলার প্রার্থীরা কেউ কেউ ঢাকা জেলার স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয়ে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। যেকোনো কারণেই হোক ঢাকা জেলার স্থায়ী বাসিন্দারা এই পদে কোটার বিপরীতে কম সংখ্যায় আবেদন করেন বলে অন্যান্য জেলার চেয়ে এখানে প্রতিযোগিতা কম হয়—এমন একটি ধারণা রয়েছে। এই সুবিধা নিতে অন্য জেলার কিছু মানুষ স্থায়ী ঠিকানার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঢাকা জেলার কোটার পদে দরখাস্ত করেন। বিশেষত ধামরাই এলাকায় স্থায়ী ঠিকানা দেখানোর প্রবণতা অতীতে লক্ষ্য করা গেছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্থায়ী ঠিকানার মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি পাওয়ার পর ১৮ জন পুলিশ কনস্টবলকে সম্প্রতি বরখাস্ত করা হয়েছে। সুতরাং নিয়োগকারীরা এ বিষয়টিতে এখন কড়া নজর দিচ্ছেন।

আসপিয়ার ঘটনায় আসা যাক। তিনি যে পদে দরখাস্ত করেছেন, সেটি জেলা কোটার পদ বলে বরিশাল জেলায় তার স্থায়ী ঠিকানা আছে কি না সেটা যাচাই করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন যিনি করেছেন, তিনি প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী বরিশালে আসপিয়ার পরিবারের স্থাবর সম্পত্তি না থাকায় পূর্বপুরুষের স্থায়ী ঠিকানা কোথায় সেটা খুঁজেছেন। দেখা গেছে সেটা বরিশাল জেলায় না, ভোলায়। পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আসপিয়ার বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। বিপত্তির শুরু এখান থেকেই।

কারণ, তিনি যদি ভোলার স্থায়ী বাসিন্দা হন, তাহলে তাকে ভোলায় পরীক্ষা দিয়ে সেই জেলার জন্য নির্ধারিত পদের বিপরীতে চাকরি পেতে হবে, বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা হলে বরিশালে। এক জেলার স্থায়ী বাসিন্দা অন্য জেলায় এই চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই।

বরিশালে ভূ-সম্পত্তি থাকা না থাকার প্রশ্নটি উঠেছে বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা কি না এটা প্রমাণ করার জন্য। পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং মূলধারার গণমাধ্যম দুটোতেই এই প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে তার বা তার পরিবারের ভূ-সম্পত্তি না থাকার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে।

সর্বশেষ খবর, তাকে জমিসহ ঘর বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতেও চাকরি পাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত নয়। কারণ, এর মধ্য দিয়ে বরিশালে তিনি এখন ভূ-সম্পত্তির মালিক হবেন, তার স্থায়ী ঠিকানা হবে। কিন্তু, বিধি অনুযায়ী, দরখাস্ত করার সময় বরিশালে তার স্থায়ী ঠিকানা ছিল কি না সেটাই বিবেচ্য হবে। সুতরাং সমস্যাটি কিন্তু মেটেনি।

এ রকম সমস্যার সমাধান কী হবে? আসপিয়ার ঘটনা ভাইরাল হওয়ার কারণেই হয়তো একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে। বরিশালের পুলিশ প্রশাসন আসপিয়ার ঘটনায় সহমর্মিতা জানালেও বিধির বাইরে গিয়ে বিষয়টি সমাধানে তাদের একক এখতিয়ার না থাকার কথা উল্লেখ করেছে।

কারণ, বিষয়টি শুধুমাত্র আসপিয়া বনাম রাষ্ট্র নয়। এখানে আরও চাকরিপ্রার্থীরা রয়েছেন। পদের সংখ্যা যেহেতু পূর্বনির্ধারিত, একজনের চাকরি হওয়া মানে আরেকজনের চাকরি না হওয়া। এ জন্য আবেদন করার সময়ে আসপিয়া বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা সেটা প্রমাণ না করতে পারলে এই পদে তাকে নিয়োগ দেওয়া কঠিন হবে। কারণ, সেক্ষেত্রে চাকরিবঞ্চিত অন্তত একজন প্রার্থী আইরি লড়াইয়ে যেতে পারেন।

আসপিয়ার ঘটনাটির অ্যাডহক সমাধানের চেষ্টা চলছে। সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের ঘটনার স্থায়ী একটা সমাধানসূত্র আবিষ্কার করা রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন। এবার ভাইরাল হয়েছে, পরেরবার অন্য একটি ঘটনা ভাইরাল না হলেও যেন সমাধান হয়। অথবা এ ধরনের ইস্যুই যেন না ওঠে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

স্থাবর সম্পত্তি থাকাটা স্থায়ী ঠিকানার বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার একমাত্র শর্ত হতে পারে না। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা দেশে কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় নদীভাঙনসহ বিভিন্ন কারণে বাস্তুহীন মানুষের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। তাদের কি তাহলে স্থায়ী ঠিকানা বলতে কিছু থাকবে না।

তারা অনেকে নিজ পূর্বপুরুষের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় পাড়ি জমান জীবিকার তাগিদে। তাদের সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করেন, বেড়ে ওঠেন সেই নতুন জায়গায়। আসপিয়ার মতোই। সেইসব মানুষদের স্থায়ী ঠিকানা কোনটাকে ধরা হবে? যেখানে তিনি জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছেন সেই জায়গা? নাকি যে জায়গায় তার পূর্বপুরুষ এককালে ছিলেন, কিন্তু অনেক বছর ধরে তার কোনো চিহ্ন নেই, তিনি নিজেও সেখানে হয়তো কোনোদিন যাননি, সেই জায়গা?

'জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮' সম্ভবত একটা সমাধান দিতে পারে। সেখানে ধারা ২(২১)-এ বলা হয়েছে, 'স্থায়ীভাবে বসবাসের স্থান' অর্থ কোন ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা বা কোন ব্যক্তি যে স্থানে ন্যূনতম ৩ (তিন) বৎসর যাবত বসবাস করিতেছেন, অথবা নদী ভাঙনে বা অন্যকোন কারণে স্থায়ী ঠিকানা বিলুপ্ত হওয়ায় নতুন কোনো স্থানে যে কোনো সময়ের জন্য বসবাস করিতেছেন বা নতুন কোনো স্থানে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে যে কোনো সময়ের জন্য উক্ত স্থানে বসবাস করিতেছেন।'

আসপিয়ার পরিবারের যদি কোথাও কোনো ভূ-সম্পত্তি না থাকতো, তাহলে হয়তো 'যে স্থানে ন্যুনতম ৩ বছর বসবাস করিতেছেন' সেই সূত্রে বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হতে পারতেন এই বিধি অনুযায়ী। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আসপিয়ার পরিবারের জমি ও বাড়ি আছে ভোলা জেলার চরফ্যাশনে। সেই জমি তারা ভোগ-দখলও করে আসছেন (চাষের জন্য বর্গা দিয়েছেন)। এই তথ্য বিষয়টিকে আরও জটিল করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, একজন নাগরিকের এক জেলায় স্থাবর সম্পত্তি থাকলে আর অন্য জেলায় বাস করলে তিনি ২ জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবেন কি না। যদি পারেন তাহলে নিজ জেলা বাদে অন্য জেলায় স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়ে চাকরি পাওয়া ও পরে বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তিদের কেসগুলো কি পুনর্বিবেচনা করা হবে? আরেকবার কি খতিয়ে দেখা হবে তারা কেউ ওইসব এলাকায় ৩ বছর বাস করেছেন কি না?

পশ্চিমা বিশ্বে এমন স্থায়ী ঠিকানা না থাকা মানুষ সরকারি কোনো সেবা নিতে গিয়ে বা চাকরিতে যোগ দিতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়ে বলে মনে হয় না। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদিতে কাজ চলে যায়।

কিন্তু আমাদের স্থায়ী ঠিকানা প্রয়োজন হয়। স্কুল-কলেজ, অফিস আদালত, ব্যাংক সব জায়গাতেই স্থায়ী ঠিকানা লিখতে হয়। তাই আমাদের জন্য বিষয়টার একটা সমাধান দরকার। সমাধানটা কী হতে পারে? স্থায়ী ঠিকানার যে সংজ্ঞা আছে সেটাকে পরিবর্তন করা, নাকি চাকরি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানার প্রয়োজনই হবে না এমন ব্যবস্থায় যাওয়া?

চাকরিতে জেলা কোটা থাকলে জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার ব্যাপারটি থাকবে। জেলা কোটা তুলে দিলে এটা প্রয়োজন নাও হতে পারে। জেলা কোটা না থাকলে সরকারি পদগুলোতে সারা দেশের মানুষের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা কঠিন। দেখা যাবে, শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কোনো কোনো জেলার মানুষ অস্বাভাবিকরকম বেশি বা অস্বাভাবিকরকম কম হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে। অঞ্চলভিত্তিক সাম্যের ব্যাপারটি থাকবে না।

কারো স্থায়ী ঠিকানা থাকা বা কোনো জায়গার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়াটা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে, সেই বিধানটিকে পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করাটা একটা সমাধান হতে পারে। এখন সরকারের কাছে জন্ম নিবন্ধনের ডেটাবেজ আছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ আছে, সুতরাং এইসব সরকারি কাগজপত্রের ভিত্তিতে বিষয়টার সমাধান হতে পারে। সমাধানটি হতে হবে খুব পরিষ্কার ও এ বিষয়ক নির্দেশনাটি হতে হবে সুনির্দিষ্ট।

তাপস বড়ুয়া: ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Public medical colleges: 86 doctors, 136 students punished since August 5

Over the last two months, at least 86 physicians and 136 students in eight public medical colleges and hospitals across the country have faced different punitive actions on various allegations, including “taking a stance against” the quota reform movement.

4h ago