কারাদণ্ডের বিকল্প হিসেবে প্রবেশনে সুফল মিলছে দেশে: মানোন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশে ২০১৮ সাল ছিল মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বছর। তখন পত্রিকার পাতা জুড়ে শত শত গ্রেপ্তারের খবর। আদালত আর কারাগারগুলোতে ছিল মাদক চোরাকারবারি ও সেবনকারীদের উপচে পড়া ভিড়। ঠিক সেই কঠিন সময়ে একজন মাদকসেবী কলেজ শিক্ষার্থীকে দণ্ডিত হওয়ার পরেও স্রোতের বিপরীতে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেন রাজশাহীর তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে ২০১৮ সাল ছিল মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বছর। তখন পত্রিকার পাতা জুড়ে শত শত গ্রেপ্তারের খবর। আদালত আর কারাগারগুলোতে ছিল মাদক চোরাকারবারি ও সেবনকারীদের উপচে পড়া ভিড়। ঠিক সেই কঠিন সময়ে একজন মাদকসেবী কলেজ শিক্ষার্থীকে দণ্ডিত হওয়ার পরেও স্রোতের বিপরীতে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেন রাজশাহীর তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

জানা গেল, এমন ছোটো খাটো অপরাধের আরও ১১ অপরাধী বাড়িতেই সাজা ভোগ করছেন।

কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বের হলো, 'পরিবারে থেকে সাজা ভোগ ১২ কয়েদির'। সেই খবরে অনেকের মনে খটকা লেগেছিল, অনাচার ভেবেছিল। কারণ অপরাধী অপরাধ করলে কারাগারে থাকবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলেও কারাগারে না গিয়ে নিজ বাড়িতে থেকেই সংশোধনের সুযোগ পাবে, সমাজের নিজ পরিমণ্ডলে তার মুক্ত জীবন-জীবিকা অব্যাহত থাকবে—এটা কীভাবে সম্ভব!

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমাদের দেশে আইনানুগভাবেই লঘু অপরাধীদের প্রবেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে কারাগারে না পাঠিয়েও পারিবারিক পরিবেশে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিশুদ্ধ করার সুযোগ করে দিয়েছে। সংশোধনমূলক এই ধারণা থেকে বাংলাদেশে কারাদণ্ডের বিকল্প হিসেবে প্রবেশন সংক্রান্ত বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পৃথক আইনও করা হয়েছে। আর প্রবেশন সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় আদালতকে সহায়তা করার জন্য এবং অপরাধীকে দেওয়া শর্তাবলী যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন।

আজ ৪ বছর পর পত্রিকা খুললে মাঝে মাঝেই প্রবেশনের খবর পাওয়া যায়। প্রবেশনের বিষয়টি আজ দেশের মানুষের কাছে নতুন নয়। এ দেশে প্রবেশনের চর্চা এর আগেও ছিল। তবে সেটা ছিল খুবই নগণ্য। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিগত কয়েক বছরের বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রবেশন সুবিধা পেয়েছিলেন ৪০৫ জন, ২০১৮-২০১৯ সালে পেয়েছেন ৫৪৩ জন, ২০১৯-২০২০ সালে সেটা দ্বিগুণ হয়ে এক হাজার ৮০ জন এবং  ২০২০-২১ সালে পেয়েছেন এক হাজার ২৭৫ জন।

করোনাকালে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকা স্বত্বেও গত ২ বছরে প্রবেশন সুবিধা বেড়েছে। শেষ ২ বছরে দণ্ডিত অপরাধীর প্রবেশন সুবিধার সংখ্যাটি খুব কম মনে হলেও এটি ক্রমাগত বাড়ছে। এই গতি চলতে থাকলে সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও বাড়িতে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তি ও কারাগারে থাকা দণ্ডিত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় সমান হবে।

কতজন প্রবেশন সুবিধা পেল তা বড় কথা নয়। প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে কতজন সফলভাবে নিজেদের শোধরাতে পারলেন, নিজেদের পুনরায় অপরাধ করা থেকে মুক্ত রাখতে পারলেন এবং এর ফলে কী কী সামাজিক পরিবর্তন এলো সেটাই আসল বিষয়।

সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে এমন কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও দু-একটি জেলার খবর পত্রিকায় পাওয়া গেছে। রাজশাহী জেলায় ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭০ জন প্রবেশন সুবিধা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩০ জন সফলভাবে প্রবেশনকাল সমাপ্ত করেছেন। মাদক মামলার ২ জন আসামি প্রবেশনের শর্ত ভঙ্গ করায় তাদের স্থগিত সাজা ভোগের জন্য কারাগারে যেতে হয়েছে (প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১)। অর্থাৎ এখানে অপরাধের পুনরাবৃত্তির হার মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা অনেক উন্নত দেশের তুলনায় ভালো।

সফলদের মধ্যে কেউ অনুতপ্ত হয়ে বেদখল হওয়া সম্পত্তি ভিকটিমকে ফেরত দিয়েছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। কেউ বয়স্ক ভাতা পেয়েছেন, নিরক্ষর কেউ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছেন (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০)। কেউ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও কারাগারের পরিবর্তে বাড়িতে সন্তান জন্মদানের সুযোগ পেয়েছেন, প্রবেশন কর্মকর্তার প্রচেষ্টায় রেস্টোরেটিভ জাস্টিস সিস্টেমের প্রয়োগে পক্ষগণের মধ্যে অবসান হয়েছে প্রবল শত্রুতার (যুগান্তর, ১৫ মার্চ ২০২১)। বই পড়ে নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন এবং কী উপলব্ধি করেছেন তার সারমর্মও আদালতে জমা দিয়েছেন, অন্য ৩ জনকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করেছেন (বাংলানিউজ২৪.কম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১)।

সম্প্রতি নড়াইলের একজন বিজ্ঞ বিচারক ৭৭ জন দণ্ডিত আসামিকে প্রবেশন সুবিধা দিয়েছেন, যার মধ্যে ৪০ জন সফলভাবে প্রবেশনকাল সমাপ্ত করেছে। তারা মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে (সময়নিউজ.টিভি, ১১ জানুয়ারি ২০২২)। এ ছাড়া এই বয়স্ক আসামিদের পাশাপাশি শিশুদেরও প্রবেশন দেওয়া হচ্ছে। সুনামগঞ্জের শিশু আদালতের একজন বিজ্ঞ বিচারক দণ্ডপ্রাপ্ত ৭০ জন শিশুকে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশনে মুক্তির সুবিধা দেন (যুগান্তর, ১৩ অক্টোবর ২০২১)।

এই যে দিন দিন ছোট অপরাধীদের মধ্যে পরিবর্তন আসছে তার পেছনে একটা সফল মন্ত্র আছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রবেশন আইনের বিধান প্রতিপালন সংক্রান্ত একটি সার্কুলারে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা প্রদান করেন। সার্কুলারটি অধস্তন আদালতের বিচারকরা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এই যে শেষ ২ বছরে ২ হাজার ৩৫৫ জন ছোট অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীরা সংশোধনে সুযোগ পেলেন, তাতে শুধু দণ্ডিতই সংশোধনের সুযোগ পাননি; এর মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রও উপকৃত হয়েছে। তারা জেল জীবনের কলঙ্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ লাভ করেছে। তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু তাদেরকে শাস্তি হিসেবে যদি কারাগারে প্রেরণ করা হতো, তাহলে তারা হয়ত দাগী অপরাধীদের সাহচর্যে আরও বড় অপরাধী হয়ে বের হতেন।

কারা অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের তথ্য মোতাবেক, বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দি মিলে মোট ২৫ হাজার ৯৭৪ জন (৩৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ) পুনরায় অপরাধ করায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। প্রবেশনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করা।

একজন প্রবেশনপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় অপরাধ না করায় সমাজ থেকে একজন অপরাধী কমে গেল। একইসঙ্গে আবার অপরাধ না করায় নতুন একটি মামলারও জন্ম হলো না। প্রবেশনাধীন ব্যক্তি রায়ের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করলে একটি মামলা বাড়ত। কিন্তু তিনি প্রবেশনে থাকার কারণে, অর্থাৎ আপীল না করার কারণে আপীল আদালতও চাপমুক্ত থেকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধের মামলাগুলোতে অধিক মনোনিবেশ করতে পারছে। এভাবে আপীলের পরিবর্তে প্রবেশনে মুক্তি এবং নতুন অপরাধ প্রতিরোধ করে মামলা জট কমানো যায়।

আমাদের দেশে কোন কোন মামলায় প্রবেশন দেওয়া যাবে তা শিশু, নারী ও পুরুষ ভেদে ভিন্নতা রয়েছে। এর জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন ও পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অপরাধের প্রকৃতি যেমনই হোক না কেন শিশু আইন, ২০১৩ এর বিধানানুযায়ী সকল শিশুই প্রবেশন পাওয়ার অধিকারী। অন্যদিকে, দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এর ৫ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ ব্যতীত অন্য সকল অপরাধে একজন নারীর প্রবেশন মঞ্জুর করা যেতে পারে। তবে পুরুষ বয়স্ক আসামিদের প্রবেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।

একই ধারা অনুসারে পুরুষ বয়স্ক আসামিদের প্রবেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে পেনাল কোডে বর্ণিত নির্দিষ্ট কিছু গুরুতর অপরাধ অথবা মৃত্যুদণ্ডে  দণ্ডনীয় বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধে প্রবেশন দেওয়া যাবে না। শুধু পেনাল কোড নয়, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ নুর মোহাম্মদ বনাম সরকার এবং অন্যান্য, ১৫ এসসিওবি আপীল বিভাগ ৭১ মামলায় এবং মতি মাতবর বনাম রাষ্ট্র, ৭৩ ডিএলআর ৮৯ মামলায় সিদ্ধান্ত দেন যে, কোনো কোনো বিশেষ আইনের মামলাগুলোতেও প্রবেশন দেওয়া যাবে। উচ্চ আদালতের এরূপ সিদ্ধান্তের কারণে দেশে প্রবেশন প্রয়োগের ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।

গত ৬০ বছরে প্রবেশন সার্ভিস এ দেশে দৃশ্যমান না হওয়ার পিছনে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ দেশের অধিকাংশ আইনজীবী, প্রসিকিউটর এবং বিচার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আসামিকে প্রবেশনের সুযোগ দেওয়া সম্পর্কে অবহিত নন। যারা বিষয়টি জানেন, তাদের মধ্যেও এটি প্রয়োগে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। এর সুফল পেতে হলে বিচারক, প্রবেশন কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসার, কারা কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং সমাজসেবা কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া প্রবেশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

আরেকটি বড় অসুবিধা হচ্ছে আমাদের দেশে নারী প্রবেশন কর্মকর্তা খুবই কম। নারীদের জন্য নারী প্রবেশন কর্মকর্তা থাকার বাধ্যবাধকতা থাকায় নারীরা তুলনামূলক কম সুবিধা পাচ্ছেন। প্রবেশন কার্যালয়ে পর্যাপ্ত জনবল ও লজিস্টিকস নেই। মাত্র একজন অফিসার এবং একজন অফিস সহায়ক দিয়ে এই কার্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে। প্রবেশন অফিসার প্রবেশনারকে তত্ত্বাবধান করা ছাড়াও নানাবিধ কার্য সম্পাদন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ভিন্ন পদেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। অধিকাংশ প্রবেশন কার্যালয় জেলা সমাজসেবা কার্যালয় ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে হওয়ায় তারা দ্রুততম সময়ে আদালতে আসতে পারেন না। পুনর্বাসন প্রবেশন ব্যবস্থার অন্যতম অংশ হলেও অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিতে বিচার বিভাগের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে পুনর্বাসনমূলক কোনো কার্যক্রমের বিষয়ে বিচারকগণ অবহিত হতে পারেন না।

প্রবেশন সার্ভিসকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের কিছু উন্নয়নমূলক, সংস্কারমূলক এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে জাতীয় প্রবেশন/সংশোধন সংস্থা গঠনপূর্বক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটিগুলোতে সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের রাখতে হবে। দিন দিন প্রবেশনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমরা স্থানীয়ভাবে প্রবেশনারকে তদারকি করতে এবং প্রবেশন অফিসারদের সহযোগিতা করতে শিক্ষিত, সচ্ছল ও সমাজসেবীদের ভেতর থেকে ভলান্টারি প্রবেশন অফিসার (ভিপিও) বা স্বেচ্ছাসেবী প্রবেশন অফিসার নিয়োগ দিতে পারি।

জাপান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রবেশনে এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া প্রবেশন কার্যালয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে আইন, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, মনোবিজ্ঞান, পুলিশ সাইন্স ইত্যাদি বিষয়ের সদ্য গ্রাজুয়েটদের নির্দিষ্ট মেয়াদে ইন্টার্ন বা ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

পেনাল কোডের ৫৩ ধারা অনুসারে, জরিমানা ছাড়া কারাদণ্ডাদেশের বিকল্প গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই উক্ত ধারা সংশোধন করে প্রবেশন, কমিউনিটিতে সাজা ভোগ, বিকল্পপন্থা, কনডিসনাল ডিসচার্জ, বাজেয়াপ্তকরণ, স্ট্যাটাস পেনাল্টিস, ভিকটিম ক্ষতিপূরণের আদেশ ইত্যাদি নন-কাস্টডিয়াল পদ্ধতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

প্রবেশনের মাধ্যমে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদান বাড়াতে হলে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এর ৬ ধারা সংশোধন করতে হবে। এই ধারা অনুসারে আদালত আসামি কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতি বা আঘাত পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অপরাধীকে ক্ষতিপূরণ এবং খরচ পরিশোধের আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ প্রদান মূল অপরাধে আরোপযোগ্য জরিমানার চেয়ে বেশি হবে না মর্মে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এ জন্য অপরাধী ও ভিকটিমের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অপরাধের ধরণ, ক্ষতির পরিমাণ ইত্যাদি বিবেচনায় আদালত কর্তৃক যৌক্তিক পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রবেশনে ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের পরিমাণ নির্ধারণ আদালতের বিবেচনাধীন রাখা হয়েছে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আপোষযোগ্য মামলায় অপরাধী প্রবেশনে গিয়ে প্রবেশন অফিসার বা তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতায় আপোষ মীমাংসা করে ফেলেছেন। এর পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। ভিকটিম ও অপরাধী যেন পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে পারেন কিংবা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে পারেন, সেজন্য প্রবেশন আইনে রেস্টোরেটিভ জাস্টিস পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে প্রবেশন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। জেলা ও দায়রা জজকে সভাপতি করে শিশু আদালতের বিচারক এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে উক্ত কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আদালত কর্তৃক স্ব-উদ্যোগে প্রবেশন মঞ্জুর করা এবং প্রাক-দণ্ডাদেশ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রবেশন মঞ্জুর করার পদ্ধতি সম্পর্কে আইন ও বিধিমালায় কোথাও সুস্পষ্টতা নেই। সম্প্রতি মতি মাতবর বনাম রাষ্ট্র, ৭৩ ডিএলআর ৮৯ মামলায় হাইকোর্ট প্রবেশন আদেশ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রবেশন অফিসারের কাছ থেকে একটি প্রাক-দণ্ডাদেশ প্রতিবেদন গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। এর প্রয়োগ ও পদ্ধতি আইন ও বিধিমালায় সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিশু, ষাটোর্ধ বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধীদের নূন্যতম প্রবেশন কাল কমানো উচিৎ। এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নূন্যতম প্রবেশনকাল ৬ মাস করা সমীচীন। প্রবেশন সেবাকে আরও সহজীকরণ করতে সাজা প্রদানের পরেও একই বৈঠকে আপীলের শর্তে জামিনের দরখাস্তের মতো আইনজীবী বা প্রবেশন অফিসারের মাধ্যমে প্রবেশনের দরখাস্ত দাখিলের বিধান করতে হবে।

প্রবেশন সেবাকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। এই সেবায় ভিকটিম, অভিযোগকারী এবং অপরাধীরা যাতে মামলার প্রত্যেকটি কার্যক্রম ও তারিখ সম্পর্কে এসএমএস এর মাধ্যমে জানতে পারেন সেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো প্রবেশনাধীন অপরাধীর গতিবিধি এবং অবস্থান জানার জন্য ইলেকট্রনিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রবেশন কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য পর্যাপ্ত মানবসম্পদ এবং লজিস্টিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

এ ছাড়া প্রবেশন অফিসারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রবেশনারদের জন্য পৃথক প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। তাদের বাজেট পৃথক করতে হবে এবং অপরাধী পুনর্বাসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরাধীনতার নিরসন করতে হবে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ অপরাধী প্রথম অপরাধী এবং তারা পেশাদার অপরাধী নন। অনেকেই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য এবং বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষাপটে অপরাধ করে বসেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রবেশনসহ কারাদণ্ডের বিকল্প পদ্ধতিগুলোর পরিকল্পিত ব্যবহার তাদের অপরাধের অন্ধকার সড়ক থেকে সরিয়ে সুপ্রবৃত্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আলোকিত জীবন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই প্রবেশন সার্ভিসের সমস্যা চিহ্নিত করে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রবেশন ব্যবস্থার আমূল এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। এতে অপরাধী সংশোধনের পাশাপাশি  কারাগারের সংখ্যাধিক্য রোধ করা সম্ভব হবে এবং কারা ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচন করাও সম্ভব হবে।

মো. সাইফুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক এবং আইনগ্রন্থ প্রণেতা

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments